Ad Code

Responsive Advertisement

ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা ইয়াসির আরাফাত

ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীক। ফিলিস্তিনিদের দখল করা ভূমিতে গড়ে তোলা রাষ্ট্র ইহুদিবাদী ইসরায়েলের দখলদারিত্ব থেকে মাতৃভূমি ফিলিস্তিনকে মুক্ত করতে আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন তিনি। আমাদের এবারের আয়োজন এই মহান নেতাকে নিয়ে। 

ইয়াসির আরাফাত


ইয়াসির আরাফাতের পরিচয়: 


২৪ আগস্ট ১৯২৯ মিশরের রাজধানী কায়রোতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আবদেল রউফ আল- কুদওয়া আল হোসাইনি ছিলেন গাজান, তবে ইয়াসির আরাফাতের দাদি ছিলেন মিশরীয়। তার পিতা কায়রোর সাক্কিনি জেলায় টেক্সটাইলের ব্যবসা করতেন আরাফাতের মা জাওয়া আবুল সউদ জেরুজালেম হতে আগত পরিবারের সদস্য। ১৯৩৩ সালে আরাফাতের বয়স যখন ৪ বছর, তখন তাঁর মা কিডনি রোগে মৃত্যুবরণ করেন। পিতা-মাতার সাত সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। আরাফাতের প্রকৃত নাম আবদেল রহমান আবদেল রউফ আরাফাত আল-কুদওয়া আল হোসাইনি। তিনি কায়রোতে বেড়ে ওঠেন। কায়রোর প্রথা অনুসারে তিনিও নামের পূর্বে মোহাম্মদ বা আহমেদ বাদ দেন। ১৯৫০ -এর প্রথম দশকে তিনি ইয়াসির নাম ধারণ করেন। তবে গেরিলা যুদ্ধে তাঁর ছদ্মনাম ছিল 'আবু আমর’ । ইয়াসির আরাফাতের পরিবার যখন জেরুজালেম আসেন তখন তাঁর পিতার আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। পিতার একার পক্ষে সাত সন্তানের দেখাশুনা অসাধ্য হয়ে পড়ে। আরাফাত এবং ছোটো ভাই ফাতিকে পুরানো শহরের মরোক্কান কোয়ার্টারে অবস্থিত মায়ের পরিবারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে তাঁর মামা সলিম আবুল সউদের সাথে চার বছর বসবাস করেন। ১৯৩৭ সালে তাদের দেখাশুনার জন্য বড়ো বোন ইনামের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৫২ সালে তাঁর পিতা মারা যান। ১৯৯০ সালে ৬১ বছর বয়সে ইয়াসির আরাফাত প্যালেস্টাইনিয়ান খ্রিস্টান ২৭ বছর বয়েসি সুহা তাউইলকে বিবাহ করেন। তবে বিবাহের পূর্বে সুহা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। বিবাহের পূর্বে আরাফাত পঞ্চাশজন অনাথকে দত্তক নিয়েছিলেন।


ইয়াসির আরাফাতের রাজনৈতিক জীবন: 


১৯৪৭ সালে তিনি ইউনিভার্সিটি অব কিং ফারুখ-১ এ ভর্তি হন এবং ১৯৫০ সালে সেখান থেকে গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি ইহুদিদের বিষয়ে অভিজ্ঞ হওয়ার জন্য জুডাইজম এবং জিউনিজমের ওপর প্রচুর অধ্যয়ন করেন। এ সময় তিনি আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন। একই সাথে Arab Higher Committee I Army of the Holy War - অনিয়মিত সৈন্যদের মাধ্যমে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত প্যালেস্টাইনকে রক্ষার জন্য অস্ত্র ক্রয় শুরু করেন। 


১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন ভাগ করে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিবাদে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে আরাফাত অন্যান্য অনেক সতীর্থদের সাথে ইউনিভার্সিটি ছেড়ে ইসরাইলি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্যালেস্টাইন গমন করেন। তিনি Palestinian fedayeen -এ যোগদানের পরিবর্তে Muslim Brotherhood -এর পক্ষে যুদ্ধ শুরু করেন। ১৯৪৯ সালের দিকে যুদ্ধ ইসরাইলের অনুকূলে চলে যেতে শুরু করে। আরবদের পরাজয় নিশ্চিত সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এ সময় আরাফাত প্রয়োজনীয় অস্ত্র, সৈনিক ও অর্থাভাবে বাধ্য হয়ে কায়রো ফিরে যান। 


কায়রো ফিরে তিনি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং অধ্যয়ন শুরু করেন এবং ১৯৫২-১৯৫৬ সাল পর্যন্ত General Union of Palestinian Students (GUPS) এর প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের প্রথম বছর Free Officers Movement -এর অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজা প্রথম ফারুককে গদিচ্যুত করেন। ইসরাইলকে উৎখাত করে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৫৯ সালে তিনি আধাসামরিক সংগঠন ‘ফাতাহ' প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার পর হতে ফাতাহ সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে অগ্রসর হয়। ফাতাহ-র এ নীতি প্যালেস্টাইনের অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও গেরিলা সংগঠনের উদ্দেশ্য হতে ভিন্ন ছিল। ১৯৫৯-২০০৪ সাল পর্যন্ত তিনি এ দলের নেতৃত্ব দেন। এ দলটি মিশর, জর্ডান, লেবাননসহ বিভিন্ন আরব দেশ থেকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকে।


১৯৬১ সালে কাতারে ধনাঢ্য ব্যবসায়ী মাহমুদ আব্বাসের সাথে আরাফাতের পরিচয় হয়। ব্যবসায়ী ও তৈল শ্রমিকগণ উদারভাবে ফাতাহকে সাহায্য করেন। ১৯৬২ সালে আরাফাত ও তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মীগণ ইসরাইলের সীমান্ত রাষ্ট্র সিরিয়া গমন করেন। সে সময় ফাতাহ এর সদস্য সংখ্যা ছিল কমবেশি তিনশ। তবে তাদের কেউ যোদ্ধা ছিল না। সিরিয়ায় আরাফাত উঁচু বেতনের একটি চাকুরি জোগাড় করে নিতে সক্ষম হন। যা তাকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের স্বপ্নকে উজ্জীবিত করে তোলে। ১৯৬৪ সালে আরব লিগ কর্তৃক প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) এর নিয়মিত সামরিক বাহিনী প্যালেস্টাইন লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) গঠিত হয়। আরাফাত প্যালেস্টাইন লিবারেশন আর্মির সদস্যদের অধিক বেতন দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে ফাতাহ -এর সদস্য সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে। ৩১ ডিসেম্বর ১৯৬৪ ফাতাহ -এর সামরিক গ্রুপের একটি স্কোয়াড আল-আসিফা হতে ইসরাইলে অভিযান চালানোর চেষ্টা করে। তবে লেবানিজ বাহিনী কর্তৃক ধৃত হয়। এ ছাড়া ফাতাহ ইসরাইলের বিরুদ্ধে এরূপ আরও বহু অভিযান পরিচালনা করেন। আরাফাত এ সকল অভিযানে নিজে ব্যক্তিগতভাবে অংশগ্রহণ করতেন।


১৯৮৩-৯৩ সাল পর্যন্ত তিনি তিউনিসিয়ায় ছিলেন এবং সশস্ত্র সংগ্রামের পরিবর্তে ইসরাইলের সঙ্গে সমঝোতা ও শান্তি আলোচনার চেষ্টা চালিয়ে যান। ১৯৮৮ সালে তিনি ইসরাইল রাষ্ট্রের অস্তিত্ব স্বীকার করে নেন এবং ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংকট নিরসনে ‘দ্বি-রাষ্ট্র’ ভিত্তিক সমাধান নীতির প্রতি সম্মতি দেন। তাঁর নেতৃত্বেই ১৫ নভেম্বর ১৯৮৮ জেরুজালেমকে রাজধানী করে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ঘোষণা দেওয়া হয়। স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে সর্বপ্রথম স্বীকৃতি দেয় আলজেরিয়া। ১৯৯০-৯১ সালে মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধে আরাফাত সাদ্দাম হোসেনের কুয়েত আক্রমণকে সমর্থন এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনী কর্তৃক ইরাক আক্রমণের বিরোধিতা করেন। ফাতাহ ও পিএলও -এর অনান্য নেতৃস্থানীয় সদস্যদের সাথে সহকারী আবু লায়াদ নিরপেক্ষ থাকার এবং সাদ্দামের সাথে কোনো জোট করার বিরোধিতা করেন। ১৭ জানুয়ারি ১৯৯১ আবু লায়াদ প্রো-ইরাকি আবু নিদাল অর্গানাইজেশনের দ্বারা নিহত হন। 


১৯৯৪ সালে তিনি গাজায় বসতি স্থাপন করেন। ফিলিপ্তিন-ইসরাইল সংকট নিরসনের লক্ষ্যে তিনি ইসরাইলের সঙ্গে বেশ কিছু শান্তি আলোচনা ও সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেন। তাঁর নেতৃত্বে ১৯৯৩ সালে ইসরাইল ও পিএলও -এর মধ্যে ঐতিহাসিক ‘অসলো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। স্বাধীন ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি না দিলেও এ চুক্তির মাধ্যমে ইসরাইল ও পিএলও পরস্পরকে স্বীকৃতি দেয়। এই চুক্তি স্বাক্ষর করায় ১৯৯৪ সালে আইজ্যাক রবিনের সঙ্গে তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার পান। তাঁর কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফলে ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৯৫ ইসরাইল ও পিএলও -এর মধ্যে গাজা ও পশ্চিম তীর সম্পর্কিত অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ফলে গাজা ও পশ্চিম তীরে সীমিত আকারে ফিলিস্তিনের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। রামাল্লাকে রাজধানী করে গাজা ও পশ্চিম তীরের প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করে পিএনএ। যার প্রেসিডেন্ট হন ইয়াসির আরাফাত। ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে ফাতাহ'র উত্থানে ফিলিস্তিনে আরেক বিপ্লবী সংগঠন হামাস'র প্রভাব কমে আসে। ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকটের দীর্ঘমেয়াদি ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘ ২০০২ সালে শান্তির জন্য রোডম্যাপ প্রস্তাব ঘোষণা করে। এ প্রস্তাব প্রণয়নে ভূমিকা রাখেন ইয়াসির আরাফাত।


কিংবদন্তির নেতা ইয়াসির আরাফাতের মহাপ্রয়াণ:


ইসরাইল কর্তৃক দুই বছর ধরে রামাল্লা অবরোধের সময় ২০০৪ সালের শেষ দিকে ইয়াসির আরাফাতের স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকে। ৭৫ বছর বয়সে ১১ নভেম্বর ২০০৪ ফ্রান্সের প্যারিসে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান এই | মহান নেতা। তাঁর মৃত্যুর আসল কারণ আজও অজানাই রয়ে গেছে। ফ্রান্সের সামরিক বাহিনী তাঁর কফিনে গার্ড অব অনার প্রদান করে এবং ফরাসি প্রেসিডেন্ট জ্যাক শিরাক আরাফাতকে একজন ‘বীর পুরুষ' হিসেবে আখ্যায়িত করেন। জেরুজালেমে পবিত্র আল-আক্বসা মসজিদের পাশে সমাহিত করার পরিকল্পনা থাকলেও ইসরাইলের আপত্তির কারণে তাকে রামাল্লায় সমাহিত করা হয়। ইসরাইলের দৃষ্টিতে তিনি একজন বিতর্কিত ব্যক্তি হলেও ফিলিস্তিনিসহ বিশ্বের নিপীড়িত মুক্তিকামী মানুষের কাছে ইয়াসির আরাফাত ছিলেন একজন পথ প্রদর্শক। তিনি বলেছিলেন, “আমার এক হাতে জলপাই গাছের শাখা (শান্তির প্রতীক), আর এক হাতে যুদ্ধাস্ত্র। আমার হাত থেকে জলপাই গাছের শাখা পড়তে দিও না।”

(তথ্য সূত্র: জয়কলি, মাসিক তথ্য কণিকা, জুন-২০২১)

Post a Comment

0 Comments

Close Menu