Ad Code

Responsive Advertisement

টিপাইমুখ বাঁধ ও বাংলাদেশ

বাঁধ নদীসভ্যতা বিনাশী দৃশ্যমান ভয়াল দানব। নিজস্ব গণ্ডি পেরিয়ে আন্তসীমান্তীয় দেশের অভিন্ন নদী প্রবাহে এর ছোবল হয় সর্বগ্রাসী। সর্বগ্রাসী মহা দানবের তেমনই একটি প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধ। সাম্প্রতিক সময়ে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণে স্বাক্ষরিত ত্রিপক্ষীয় চুক্তির প্রেক্ষাপট বিষয়টিকে নতুন করে নিয়ে এসেছে সবার সামনে। বাংলাদেশ ভারত বন্ধুপ্রতীম সম্পর্কের মধ্যে বিদ্যমান সংকটের হিমশৈলের ভাসমান চূড়া হয়ে আবির্ভূত হয়েছে জাতীয় স্বার্থবিরোধী টিপাইমুখ বাঁধ ইস্যু। তাই প্রবন্ধ বিভাগে আমাদের এবারের আয়োজন টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে।


টিপাইমুখ বাঁধ: 

ভারতের মণিপুর রাজ্যের মিজোরাম সীমান্তের কাছে চুরাচাঁদপুর জেলার দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল টিপাইমুখে বরাক নদীর উপর ভারতের নির্মিতব্য একটি বাঁধ হলো টিপাইমুখ বাঁধ। এটি বরাক ও টুইভাই নদীর সঙ্গমস্থল থেকে ৫০০ মিটার ভাটিতে এবং বাংলাদেশের সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলার অমলশিদ সীমান্ত থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার উজানে অবস্থিত। বাঁধটির উচ্চতা ১৬২.৮ মিটার এবং দৈর্ঘ্য ৩৯০ মিটার। এটি আন্তর্জাতিক মানে একটি মুখ্য বাঁধ। এ বাঁধটি মূলত একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। সর্বোচ্চ দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষম টিপাইমুখ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটি উচ্চতার দিক থেকে ভারতে সপ্তম । টিপাইমুখ ড্যাম শুধু বাঁধ বা ড্যাম নয়, একই সাথে একটি 'ব্যারেজ'ও। কারণ এ বাঁধ থেকে ৯৫ কিলোমিটার। ভাটিতে ফুলেরতল ব্যারেজের প্রস্তাব রয়েছে। ব্যারেজটি তির্যকভাবে ১০০ কি.মি. ভাটিতে এবং সিলেটের সীমানায় অমলশিদ থেকে উজানে প্রায় ১০০ কি.মি. তির্যকভাবে অবস্থিত। উল্লেখ্য ‘ড্যাম' ও ‘ব্যারেজ' উভয়কেই বাংলায় ‘বাঁধ’ বলা হয়ে থাকে। ড্যামের উদ্দেশ্য জলবিদ্যুৎ উৎপাদন এবং ব্যারেজের উদ্দেশ্য পানি ধারণ করে সুবিধামত প্রত্যাহার করে অন্যত্র বয়ে নিয়ে যাওয়া।


বাঁধ নির্মাণের ইতিহাস:

টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের ধারণার সূত্রপাত মূলত বন্যা নিয়ন্ত্রণের চাহিদা থেকে। ১৯৩০ সালে সালের দিকে আসামের কাছাড় উপত্যকায় এক ভয়াবহ বন্যার পর একটি দীর্ঘমেয়াদী বন্যা নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রথম ১৯৫০ সালে বরাক নদে এ বাঁধ নির্মাণের কথা আলোচিত হয়। এরপর ১৯৫৫ সালে বরাক নদে বাঁধ নির্মাণের জন্য মণিপুরের ময়নাধর অঞ্চলকে নির্ধারণ করা হয়। এরপর পরিকল্পনা বদলে ১৯৬৪ সালে নারায়ণধর, তারপর ভুবনধরে এ বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। পরে এ সিদ্ধান্তও বদলে যায়। ১৯৮০ সালে এসে বাঁধের স্থান নির্ধারণ করা হয় টিপাইমুখে। ১৯৯৩ সালে বাঁধ নির্মাণ শুরুর উদ্যোগ নেয়া হয়। তবে ভারতের কিছু অঞ্চলে কিরূপ প্রভাবের কথা চিন্তা করে তখন থেমে যায় উদ্যোগটি। পরে আবার উদ্যোগ নেয়া হয়। ১৯৯৯ সালের ৯ জানুয়ারি মণিপুর রাজ্য সরকার টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। ২০০৬ সালে বাঁধের নির্মাণকাজের ঠিকাদার নির্বাচন করতে বিজ্ঞাপন প্রকাশ পায়। বাঁধের ডিজাইন চূড়ান্ত হয় ২০০৮ সালে। তারপর ২৮ জুলাই ২০০৮ মণিপুর রাজ্য সরকার বাঁধের নিরাপত্তা ও নির্মাণসামগ্রী আনার জন্য আইন পাস করে এ একই বছরের ২৪ অক্টোবর প্রকল্পটির পরিবেশ ছাড়পত্র দেয়া হয়। এ কাজের জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডারকে দায়িত্ব দেয়া হয়। মাঝে আবারও কাজের বিরতি পড়ে। এখন নতুন করে এ বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে ভারত। টিপাইমুখ বাঁধ ভারতের ‘বহুমুখী জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের সেচ ও নদীবিষয়ক উচ্চাভিলাষী ‘জাতীয় নদী সংযোগ প্রকল্প'র অংশ।


টিপাইমুখে বাংলাদেশ সংশ্লিষ্টতা: 

নদীবিধৌত বাংলাদেশ প্রায় তিন দিক ভারত বেষ্টিত। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রবাহিত আন্তর্জাতিক নদীর সংখ্যা ৫৪টি। এর মধ্যে ৫৩টি নদীই ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। দু'দেশের মধ্যে বহমান বিশালায়তনের নদীপ্রবাহের একটি উৎসমুখ হলো বরাক নদী। একটি অভিন্ন নদী প্রবাহ হিসেবে বরাক নদীটি ভারতের মণিপুর, মিজোরাম ও আসাম রাজ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার অমলশিদের কাছে বাংলাদেশে প্রবেশ করে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীতে বিভক্ত হয়েছে। সুরমা ও কুশিয়ারা নদী হবিগঞ্জে মারকুলির কাছে একত্রিত হয়ে প্রথমে কালনী এবং পরে মেঘনা নাম ধারণ করেছে। মেঘনা নদী গঙ্গা ও যমুনা নদীর মিলিত স্রোতধারা পদ্মা নদীর সাথে চাঁদপুরের কাছে মিলিত হয়ে মেঘনা নামে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। বরাক নদীর মোট দৈর্ঘ্য ৯৪৬ কিলোমিটার, যার মধ্যে ভারতে পড়েছে ২৭৭ কিলোমিটার এবং বাংলাদেশে পড়েছে ৬৬৯ কিলোমিটার। প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধ এর নির্মাণ স্থান এই বরাক নদীই, যা বাংলাদেশের সিলেট সীমান্ত থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার উজানে অবস্থিত। তাই বরাক নদীর প্রবাহ সংশ্লিষ্টতায় ভৌগোলিক তথা পরিবেশগত ও প্রতিবেশগত প্রভাব বিবেচনায় টিপাইমুখ বাঁধ ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। ফলশ্রুতিতে ভারত কর্তৃক নির্মাণাধীন টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের তুলনায় বেশি উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ।


টিপাইমুখের বিরূপ প্রভাব ও বাংলাদেশ: 

টিপাইমুখ বাঁধ— নদীর উপর বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গির একটি বহুল আলোচিত ভারতীয় জলবিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প। সহজে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া এবং শিল্পোয়ন্ননে দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য টিপাইমুখ বাঁধটি ভারতের জন্য যতটাই স্বার্থমুখী, ঠিক অতটাই বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী এবং এ প্রকল্পের ঝুঁকি ও বিপদ বহুলাংশে বাংলাদেশের উপর বর্তাবে। আঞ্চলিক নিরাপত্তা ঝুঁকি, নকশাজনিত ঝুঁকিসহ প্রাকৃতিক দুর্ঘটনাজনিত বিপর্যয়ের সমূহ সম্ভাবনার মুখে দাঁড়ানো টিপাইমুখ বাঁধ খুব দ্রুতই বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মেঘনা অববাহিকায় পরিবেশ ও প্রতিবেশগত বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে। ভারতের সুকৌশলী ও ভয়াবহ পানি আগ্রাসনের শিকার বাংলাদেশের জন্য ফারাক্কারূপী নতুন মরণফাঁদ এই টিপাইমুখ বাঁধ। তাই এটি সার্বিকভাবে বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষের আবাসস্থল, কৃষি, শিল্প, মৎস্যসম্পদ এবং বনজ সম্পদের অপূরণীয় ক্ষতি করবে। সর্বোপরি, বাংলাদেশে টিপাইমুখ বাঁধের বিরূপ প্রভাব পড়বে চতুর্মুক দিকে । যেমন— 


আঞ্চলিক নিরাপত্তা ঝুঁকি : 

নিরাপত্তাহীনতা টিপাইমুখ বাঁধের অন্যতম ঝুঁকি। রাজনৈতিক দিক থেকে টিপাইমুখ একটি অগ্নিগর্ভ অঞ্চল। এখানে সরকারের নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। তদুপরি, টিপাইমুখ বাঁধের মতো প্রকল্প স্থানীয় আদিবাসীদের বিদ্রোহী করে তুলেছে। কেননা এ বাঁধ তাদের চিরাচরিত জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এ ধরনের রাজনৈতিক অস্থিতিশীল অঞ্চলে টিপাইমুখের মতো বৃহৎ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। যে কোনো সময় ভারতবিরোধী সন্ত্রাসীরা এ বাঁধ উড়িয়ে দিতে পারে। এতে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের ক্ষতি বেশি হবে। এ বাঁধের নিরাপত্তা তাই বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের বিষয়।


ত্রুটিপূর্ণ নকশা ও বন্যা ঝুঁকি : 

টিপাইমুখ বাঁধের ত্রুটিপূর্ণ নকশায় বন্যার ঝুঁকি অত্যন্ত প্রবল। বাঁধের নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হলো Overtopping বা বন্যার সময় অস্বাভাবিক অতিবৃষ্টির ফলে পানি বাঁধের ওপর দিয়ে চলে যাওয়া। এ ধরনের ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। ভারতের পরিবেশ দপ্তরের বিবেচনায় টিপাইমুখ বাঁধে সর্বোচ্চ বন্যাসীমা অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণভাবে প্রাক্কলন করা হয়েছে। এতে মাত্র ১৬ বছরের তথ্য ব্যবহার করে ১০০ বছরের সর্বোচ্চ বন্যার প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। অথচ এত অল্প সময়ের উপাত্তের ভিত্তিতে এ হিসাব সম্ভব নয় । এ বাঁধের নকশায় অনুমান করা হয়েছে, টিপাইমুখে ১০০ বছরে একবার সর্বোচ্চ পানির প্রবাহ হবে ৪৯৩১ কিউসেক। কিন্তু বরাক নদীতে টিপাইমুখে ৯১০০ কিউসেক পানি প্রবাহের নজির রয়েছে। তাই টিপাইমুখ বাঁধের ধসে যাওয়া বা ভেঙ্গে যাওয়ার ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি। এক্ষেত্রে অবর্ণনীয় ক্ষতির শিকার হবে বাংলাদেশ। শিলচর শহর ৯ থেকে ৩২ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যেতে পারে, বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে যার দূরত্ব মাত্র ২৮.৫ মাইল। যদি ৫০ কিলোমিটার বেগে পানি নামে, বাঁধ ভাঙার পানি এক ঘণ্টার কম সময়ে শিলচর থেকে সিলেটের জকিগঞ্জে পৌছে যাবে । দুই-তিন ঘণ্টার মধ্যে সুরমা ও কুশিয়ারার পারে শুরু হবে মৃত্যু আর ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা ।


বিস্তৃত মরুকরণ ও নদ-নদীর বিলুপ্তি : 

টিপাইমুখ বাঁধ ভারতের আরেকটি পানি আগ্রাসনের সর্বগ্রাসীরূপ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। কারণ টিপাইমুখ বাঁধের নির্মাণস্থান বরাক নদীটি মেঘনা নদীর আদি পর্যায়। সীমানা পেরিয়ে আসা ৫৪টি নদীর মধ্যে ২২টি নদী মেঘনাকে পানি দিয়ে থাকে। ভারত ইতোমধ্যে এগুলোর অধিকাংশ নদীতে বাঁধ দিয়ে পানি সরিয়ে নিচ্ছে এবং অবশিষ্ট নদীগুলোতেও বাঁধ দেয়ার পরিকল্পনা করছে। নির্মিত ও চালু হলে টিপাইমুখ ড্যাম সুরমা ও কুশিয়ারার পাশাপাশি মেঘনার পানি প্রবাহকেও বাধাগ্রস্ত করবে। এর অশুভ প্রভাবে বৃহ সিলেট, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, শরীয়তপুর ও বরিশালসহ মেঘনা অববাহিকার বিস্তীর্ণ এলাকায় দ্রুত মরুকরণ ঘটবে। নৌপরিবহন অচল হয়ে পড়বে। টিপাইমুখ ড্যাম ও ফুলেরতল ব্যারাজের কারণে মেঘনা নদীর মোহনায় মিষ্টি পানির গভীরতা আরও কমে যাবে এবং সমুদ্রের লোনা পানি দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে সেই কমে যাওয়া গভীরতাকে পূরণ করবে। মেঘনার মোহনার পানির গভীরতা মাত্র ৫ মিটার কমে গেলে লোনা পানির সেই স্থান দখল করে সিলেট শহর পর্যন্ত পৌঁছে যাবে এবং ১৬টি জেলায় মরুকরণের প্রক্রিয়া শুরু হবে এবং ৪ কোটিরও বেশি মানুষ বিপর্যস্ত হবে। এ সাথে ফারাক্কা বাঁধ এবং গঙ্গার উজানে আন্তঃনদী পানি স্থানান্তর প্রকল্পের প্রভাব একত্রিত করলে বাংলাদেশের ৬০ ভাগ এলাকা মরুভূমিতে পরিণত হবে। টিপাইমুখ থেকে টারবাইনের ভেতর দিয়ে যে পানি আসবে তা হবে। পলিমুক্ত। এর পলিধারণ ক্ষমতা অনেক বেশি আর তাই এটি বাঁধের ভাটিতে ১০০ থেকে ১৫০ কিলোমিটার ব্যাপী ব্যাপক নদী ক্ষয়ের সৃষ্টি করবে।


হাওড়-বাওড়ের বিলুপ্তি: 

বরাক-সুরমা অববাহিকার বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এখানে রয়েছে বিশাল জলাভূমি ও অসংখ্য হাওরের একটি নিজস্ব বাস্তুসংস্থান । বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং-এর প্রাথমিক গবেষণার আলোকে (২০০৫) জানা যায়, টিপাইমুখ বাঁধের কারণে সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার জলাভূমি ও হাওরের এলাকা আগের চেয়ে গড়ে যথাক্রমে ২৬ ও ১১ শতাংশ কমে যাবে, কুশিয়ারা নদী তীরে অবস্থিত কুশিয়ারা-বর্দাল হাওর গড় বর্ষার সময় পুরোপুরি শুকিয়ে যাবে এবং কাওয়ারদিঘি হাওরের ২৬ শতাংশ প্লাবন এলাকা হারাবে। এ টিপাইমুখ বাঁধ সিলেট অঞ্চলের কতটা ক্ষতি করবে তা অকল্পনীয়। পুরোপুরি পানিনির্ভর সিলেটের এ অঞ্চলের কৃষি গড়ে উঠেছে হাওর অঞ্চলের পানির স্বাভাবিক প্রবাহের ওপর ভিত্তি করে। বাঁধের ফলে ধান চাষের মৌসুমে পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যাবে না, সাথে ফুলেরতল ব্যারেজের মিলিত প্রভাব এ পরিস্থিতির আরো মারাত্মক অবনতি ঘটাবে। বাঁধের ফলে পানি যেটুকু আসবে তা নিম্নতাপমাত্রার হওয়াতে দ্রবীভূত নাইট্রোজেনের পরিমাণ বেশি হবে, যা প্রাণহীন ও পলি বয়ে আনার অনুপযুক্ত হবে। এতে পাললিক ভূমির স্বাভাবিক উর্বরতা হ্রাস পাবে। মাছসহ জলজ প্রাণের অস্তিত্ব ধ্বংস হবে।


ভূমিকম্প ঝুঁকি : 

টিপাইমুখ ভূতাত্ত্বিক দিক থেকে একটি অতি স্পর্শকাতর অঞ্চল। এটি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এলাকা। পৃথিবীর সর্বোচ্চ ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ ছয়টি অঞ্চলের একটি হলো টিপাইমুখ বাঁধের নির্মাণস্থল। পাঁচটি টেকটনিক সেটিংস-এ বিভক্ত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ১৮৬৯ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত রিখটার স্কেলে ৭ বা তার চেয়ে বেশি মাত্রার ভুমিকম্প ঘটেছে ১৭টি। আর টিপাইমুখ বাঁধটি যে জোনে নির্মিত হচ্ছে, সেখানে পৃথিবীর ইতিহাসে বহুল আলোচিত ১৮৯৭ সালের ১২ জুন সংঘটিত হয়েছিল ৮.৭. মতান্তরে ৮.৩ মাত্রার 'দি গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েক' খ্যাত ভূমিকম্পটি । উৎসস্থল থেকে ৭০০ কিমি ব্যাসার্ধ জুড়ে ভয়ানক ক্ষতি করেছিল এ ভূমিকম্প । টিপাইমুখ বাঁধ থেকে ১০০ কিমি ব্যাসার্ধের মধ্যে গত ১০০ বছরে রিখটার স্কেলে ৫-এর অধিক মাত্রার শতাধিক ভূমিকম্প ঘটেছে। বাঁধের স্থান থেকে মাত্র ৭৫ কি.মি. দূরে সর্বশেষ ১৯৫৯ সালে ৭-এর চেয়ে অধিক মাত্রার ভূমিকম্প ঘটেছে। ভূমিকম্প একবার যেখানে ঘটে সেখানে শত বছর পর আবারও একই মাত্রায় ঘটতে পারে। সুতরাং ১৮৯৭ সালের মতো একই মাত্রার কিংবা ভয়াবহ মাত্রার ভূমিকম্প ঐ একই স্থানে যে কোনো সময় ঘটতে পারে এবং টিপাইমুখ বাঁধ বিধ্বস্ত হতে পারে। এছাড়া জলাধার আবেশিত ভূমিকম্প-এর আশংকা তো আছেই। বাঁধের কারণে টিপাইমুখে ৫০০ ফুট গভীর জলাধার তৈরি হবে এবং এ কারণে জলাধারের নিচের মাটিতে প্রতি বর্গমিটারে ১৬০ টনের বেশি চাপ বেড়ে যাবে, যা ভূমিকম্পকে ত্বরান্বিত করবে। ভূমিকম্পে টিপাইমুখ বাঁধ ভেঙে গেলে প্রচণ্ডবেগে ধাবিত জলরাশি ও পলিমাটি আবর্জনা ৩ কোটি বাংলাদেশীর সলিল সমাধি ঘটাবে। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংকট : টিপাইমুখ বাঁধের বিরূপ প্রভাবের অনিবার্য পরিণতি হবে পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের মারাত্মক সংকট। বাঁধের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মেঘনা-অববাহিকায় অকল্পনীয় পরিবেশ ও প্রতিবেশগত বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে। বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ মানুষের আবাসস্থল, কৃষি, শিল্প, মৎস্য সম্পদ, বনজ সম্পদের দিক থেকে অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হবে। বাঁধ চালু হওয়ার ২০-২৫ বছরের মধ্যে সিলেট ও কিশোরগঞ্জ অঞ্চলের হাওর-বাঁওড়গুলো বিলুপ্ত হয়ে যাবে। অপ্রতিরোধ্য প্রতিবেশগত বিপর্যয়ের ফলে বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য বিলুপ্ত হয়ে ৫ কোটি মানুষের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতি ধ্বংস হয়ে যাবে। রিভার মরফোলজিতে নিদারুণ পরিবর্তন আসবে। পরিবেশ ও প্রতিবেশগত বিপর্যয়ের ফলে দেখা দিবে পরিবেশ উদ্বাস্তু সমস্যা। ফলশ্রুতিতে ঐতিহ্যগত জীবনযাত্রা হারাবে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের মানুষ ।


জাতীয় স্বার্থ রক্ষার দায় ও করণীয়: 

স্বার্থ সংশ্লিষ্টতায় নির্মাণাধীন টিপাইমুখ বাঁধ বাংলাদেশের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। কেননা নদীকেন্দ্রিক সভ্যতায় গড়ে ওঠা এ দেশের মানুষের সংস্কৃতিবোধ ও জীবনযাত্রাসহ পরিবেশগত এবং প্রতিবেশগত কর্মকাণ্ডের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কিংবা উন্নয়নে সীমাহীন বিরূপ প্রভাব ফেলবে টিপাইমুখ বাঁধ। এক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ রক্ষার দায়ে টিপাইমুখ বাঁধের বিষয়ে করণীয় হলো : প্রয়োজনীয় সমীক্ষার মাধ্যমে টিপাইমুখ বাঁধের ঝুঁকি ও বিরূপ প্রভাব চিহ্নিত করা 

  • আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহুমাত্রিক ও দ্বিপক্ষীয় কূটনীতির মাধ্যমে সমস্যাটির ভয়াবহতা তুলে ধরা

  • বাঁধ তৈরির আগে প্রাথমিক পর্যায় থেকে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা 

  • ঝুঁকি হ্রাসের জন্য টিপাইমুখ বাঁধের বিকল্পের সম্ভাব্যতা পরীক্ষা করা। এতে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে সম অধিকারে ঝুঁকিহীন প্রকল্পকে অগ্রাধিকার প্রদান 

  • বাঁধ নির্মাণের আগে এবং পরে প্রয়োজনীয় জলপ্রবাহ পাওয়ার বিষয়ে গ্যারান্টি নিশ্চিত করা 

  • বাঁধজনিত কারণে দেশের কোনো ক্ষতি না হওয়ার বিষয়ে নিশ্চয়তা লাভের পাশাপাশি। অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা বা ক্ষতির প্রশ্নে দ্ব্যর্থহীন সাহায্য-সহযোগিতা ও ক্ষতিপূরণ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া 

  • আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া 

  • টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ বিষয়ে ভারতের স্বচ্ছতার নিশ্চয়তা বিধান করা 

  • পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষায় শক্তিশালী আন্তদেশীয় চুক্তি করা। 

সর্বোপরি জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় সমঝোতার ভিত্তিতে এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার আলোকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সবাইকে এগিয়ে যেতে হবে দেশ মাতৃকার টানে ।


টিপাইমুখ বাঁধ


আন্তর্জাতিক নদীশাসন ও ব্যবহারসংক্রান্ত নীতিমালা 

  • হেলসিংকি নীতিমালা (১৯৬৬) : ৪ ও ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত দেশ, অভিন্ন নদীর ব্যবহারের ক্ষেত্রে অন্য দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজন বিবেচনা করবে। এ জন্য অবশ্যই অন্য দেশের যাতে কোনো ক্ষতি না হয়, সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে 

  • জাতিসংঘ কনভেনশন ১৯৭৭: United Nations Convention on the Law of the Non-navigational Uses of International Water Courses 1977. এর অনুচ্ছেদ ৫-এ বলা হয়েছে সর্বোচ্চ টেকসই ব্যবহার ও উপকারের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে পানি-প্রবাহ পর্যাপ্ত সংরক্ষণ নিশ্চিত করে অভিন্ন নদীপ্রবাহের দেশগুলো ন্যায্য ও যৌক্তিক উপায়ে আন্তর্জাতিক পানি প্রবাহ ব্যবহার করবে

  • নো হার্ম রুল : জাতিসংঘ নীতিমালার (১৯৯৭) ৭ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রতিটি দেশ আন্তর্জাতিক | পানিপ্রবাহ থেকে পানি ব্যবহারের সময় পার্শ্ববর্তী একই অববাহিকার অন্যান্য দেশের যাতে কোনো বড় ধরনের ক্ষতি না হয়, সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

  • UNEP Convention on Biological Diversities, 1992-এ বলা হয়েছে, পৃথিবীর প্রতিটি দেশ বিশ্বের পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ

  • রামসার কনভেশন অন ওয়েটল্যান্ডস ১৯৭১-এ বলা হয়েছে জলজ বাসব্যবস্থা ও প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার জন্য জলাধার সুরক্ষায় প্রতিটি দেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ

  • World Commission on Dams (WCD) 1998-এ বলা হয়েছে, কোনো নদীতে বড় ড্যাম তৈরি করতে চাইলে সেই নদী বেসিনের মানুষের কাছে অবশ্যই এ ড্যামের গ্রহণযোগ্যতা (Peoples' Acceptance) নিশ্চিত করতে হবে।

Post a Comment

0 Comments

Close Menu