Ad Code

Responsive Advertisement

জাতির জনক বিপ্লবী নেতা হো চি মিন

ভিয়েতনামের জাতির জনক
জাতীয়তাবাদী ও সাম্যবাদী বিপ্লবী নেতা
হো চি মিন

হো চি মিন

হো চি মিন
জন্ম : ১৯ মে ১৮৯০
মৃত্যু : ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৬৯


সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও জাতীয়তাবাদী যে কয়েকজন নেতার নাম আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি তাদের মধ্যে কমরেড হো চি মিন অন্যতম। ভিয়েতনামের স্বাধীনতা সংগ্রামের পুরোধা ব্যক্তিত্ব তিনি। বিশ্ব ইতিহাসে যে কয়জন ব্যক্তি একটি জাতির জন্য স্বাধীনতার দূত হয়ে এসেছিলেন হো চি মিন তাদের মধ্যে অন্যতম। একজন সাধারণ মানুষ কীভাবে একটি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা হয়ে উঠতে পারেন তারই বড়ো প্রমাণ তিনি। এই আধুনিক বিশ্বেও তাঁর কীর্তি সবার জন্য অনুকরণীয়।


হো চি মিনের জন্ম ও শৈশব 

১৯ মে ১৮৯০ ন-ঘিয়ান প্রদেশের চুয়াগ্রামে হো চি মিন জন্মগ্রহণ করেন। ভিয়েতনামবাসী তাকে ভালোবেসে ‘অ্যাংকেল হো বলে ডাকে। ছোটবেলায় তাঁর নাম ছিল ‘নগুয়েন ভ্যান কুং’। দেশের প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসার ফলে তিনি পরিচিত হন নগুয়েক আই কুয়োক (দেশপ্রেমিক নুয়েন) নামে। পরবর্তীতে সারা বিশ্বে তিনি পরিচিত হন হো চিন মিন বা আলোর দিশারী হিসেবে। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় নগুয়েন ভ্যান কুং, নগুয়েন তাত থান, ভুয়ং সন নিহি, লিনভ ছাড়াও অনেক ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন। তাঁর পিতা নগুয়েন উই ছিলেন কনফুসীয় পণ্ডিত ও ম্যাজিস্ট্রেট এবং মাতা হোয়াং আই লোয়ান ছিলেন গৃহিণী। টানাপোড়েনের সংসারে তিন ভাই ও এক বোনের সংসার চালাতে তাঁর বাবাকে হিমশিম খেতে হতো। শৈশবেই তাঁর মা অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে প্রথমে গ্রামের পাঠশালায় ভর্তি করে দেন তাঁর বাবা। গ্রামের পাঠশালায় খুব ভালো করার পরে তাঁকে শহরের একটি হাইস্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়। শহরে এসেই তিনি বুঝতে পারেন নিজেদের মাতৃভূমিতে কোনো অধিকার নেই। তাদের দেশ শাসন করছে ফরাসিরা। স্কুলের প্রধান শিক্ষক ফরাসি। অন্য শিক্ষকরা ভিয়েতনামি হলেও প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে কিছু বলার সাহস নেই কারও। স্কুলের এসব পরাধীনতা তাকে বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে।


শিক্ষাজীবন ও বিপ্লবী হো চি মিন 

ঔপনিবেশিক আমলে ভিয়েতনাম ফরাসিদের কব্জায় ছিল। ভিয়েতনাম, লাওস এবং কম্বোডিয়া নিয়ে তখন গঠিত ছিল ইন্দো-চায়না। ১৮৫৯ সালের পর একের পর এক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি অর্থনীতি তথা আর্থ | সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে দেশটিকে প্রায় পঙ্গু করে রেখেছিল। ভিয়েতনাম ১৮৮৩ সালে সাম্রাজ্যবাদী ফ্রান্স পুরোপুরি দখল করে। ভিয়েতনাম হয়ে দাঁড়ায় | ফ্রান্সের সরাসরি উপনিবেশ। সে সময় বিচ্ছিন্নভাবে কিছু আন্দোলন হলেও সুসংগঠিত কোনো আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। ১৯০৮ সালের কৃষক আন্দোলনের সাথে স্কুল জীবনেই হো চি মিন জড়িয়ে পড়েন। তাঁর সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেন তাঁর বাবা নগুয়েন সাক। পরিণতি হিসেবে শাসকগোষ্ঠী অন্যান্য আন্দোলনকারীর সঙ্গে তাঁর বাবাকেও গ্রেফতার করে। বাবা গ্রেফতার হওয়ার সঙ্গে শেষ হয় হো চি মিনের ছাত্রজীবন এবং শুরু হয় প্রত্যক্ষ সংগ্রামী জীবন। ১৯১০ সালে তিনি প্রায় ৫০০ কিমি পথ অতিক্রম করে। ফান থিয়েট শহরে আসেন। সেখানে একটি প্রাথমিক | বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। এখানেই তিনি পরিচিত হন দেশপ্রেমিকদের এক গোপন বিপ্লবী | সংগঠনের সাথে। তিনি এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ঘুরে ঘুরে মানুষের কাছে প্রচারপত্র বিলি করতেন এবং বোঝাতেন অত্যাচারী ফরাসিদের দেশ থেকে বিতাড়ন না করলে দেশের মানুষের মুক্তি নেই। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি হয়ে উঠলেন বিপ্লবী আন্দোলনের প্রথম সারির নেতা। আর এজন্য ফরাসি গুপ্তচর বাহিনীর শ্যেনদৃষ্টি পড়ে তাঁর ওপর। তাঁর বাবাকে পৌলো বন্দর কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। এ সময় বাবার সঙ্গে পুত্রের দেখা হলে বাবা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলেন তার এ তরুণ সন্তানের মনে ব্যাপক ক্ষোভ আর যন্ত্রণা। তিনি অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে উপলব্ধি করলেন এ সন্তান তার একার নয়। এ সন্তান এখন সারা ভিয়েতনামের সংগ্রামী মানুষের। তিনি পুত্রকে প্যারিসে পাঠানোর চিন্তা করলেন। ২ জুন ১৯১১ হো চি মিন সায়গান ও ফ্রান্সের ভার্সাই বন্দরের মধ্যে যাতায়াতকারী এস এস লা তুচে ত্রিভেলি নামের জাহাজে সহকারী রাঁধুনির কাজ নেন। পরবর্তী তিন বছর তিনি জাহাজে করে জীবিকা অন্বেষণের কাজে ঘুরে বেড়ান ইউরোপ, আমেরিকা এবং আফ্রিকার বিভিন্ন বন্দরে। জাহাজে ঘুরতে ঘুরতে তিনি নিউইয়র্কে পৌঁছান। এই তিন বছর অবসরে পড়তেন ইতিহাস বই ও সংবাদপত্র। উদ্দেশ্য পশ্চিমা সমাজ ও রাজনীতির সঙ্গে পরিচিত হওয়া। 


হো চি মিনের ভার্সাই সম্মেলন এবং আট দফা দাবি 

নানা দেশ ঘুরে হো ১৯১৭ সালে ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে প্যারিসে এসে দেখতে পান | ভিয়েতনামের উপনিবেশ গড়ে তোলা ফরাসিদের সঙ্গে সামান্যতম মিল নেই। তিনি যখন ফ্রান্সে বসবাস শুরু করেন তখন ফ্রান্সে শ্রমিকশ্রেণির নেতাদের সাথে সেই সময় তাঁর বেশ ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায়। ১৯১৯ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর ফান্সের ভার্সাই শহরে জার্মানি ও মিত্রবাহিনীর মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা 'ভার্সাই চুক্তি' নামে পরিচিত। সাম্রাজ্যবাদী দস্যুরা ১৯১৯ সালের বসন্তকালে সম্মিলিত হন ভার্সাইতে। উন্নত বিশ্বের নেতারা যখন নিজেদের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে ব্যস্ত, ঠিক তখনই বোমা ফাটান বিপ্লবী নেতা হো চি মিন। তিনি নগুয়েন ভ্যান কুং ছদ্মনামে বজ্রকণ্ঠে উত্থাপন করেন আট দফা দাবি। ভিয়েতনামি জনগণের পক্ষ থেকে 'জাতিসমূহের অধিকার’ শিরোনামে আট দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেন। শুরু হয় হো মিনের ছদ্মনাম গ্রহণের পালা। ভার্সাইতে তাঁর উপস্থাপিত মূল বিষয়গুলোর মধ্যে নিয়ন্ত্রণাধিকার, রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি, ফরাসি ও ভিয়েতনামিদের মধ্যে সমান অধিকার, জবরদস্তিমূলক শ্রম বিলোপ, লবণ কর রহিত, জবরদস্তিমূলক মদ্যপান ব্যবস্থার বাতিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই প্রস্তাবই হলো সাম্রাজ্যবাদী দস্যুদের বিরুদ্ধে তাঁর প্রথম আঘাত। ভিয়েতনামের ওপর কর্তৃত্বকারী ফ্রান্সের বুকে বসে ফরাসি উপনিবেশবাদ বিরোধী তার পিতৃ-মাতৃভূমির মুক্তির সনদ দাখিল করলেন হো চি মিন। অবাক বিস্ময়ে দেখল বিশ্ব। । 


হো চি মিনের দেশে দেশে বিপ্লবী ভাষণ 

২৫-৩০ ডিসেম্বর ১৯২০ পর্যন্ত ছয় দিনের প্যারিস সফরে যান এ বিপ্লবী নেতা। সেখানে ফরাসি সোশ্যালিস্ট পার্টির ১৮৩তম অধিবেশনে ভিয়েতনামের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন। বিশ্ব প্রতিনিধিদের সামনে তুলে ধরেন ভিয়েতনামের ওপর ফরাসিদের নিপীড়নের কথা। দেশের মানুষের ঐক্য আর সংগঠনের মাধ্যমে বিপ্লব গড়ে তুলতে গঠন করেন ভিয়েতনামি বিপ্লবী তরুণ সংঘ। | প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯২৩ সালে তিনি মস্কোতে | অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে যোগ দেন। | ভিয়েতনামের স্বাধীনতা আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করতে তিনি 'ভিয়েতমিন’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করেন। ভিয়েতনামের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন পরিচালনায় তাঁর এই সংগঠন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯২৫-২৬ সালে তিনি সংগঠিত করেন ‘তরুণ শিক্ষা শ্রেণি’ এবং এতে মাঝে মাঝে ভিয়েতনামি জাতীয়তাবাদীদের সামনে বক্তৃতা দিতেন। তিনি অক্টোবর ১৯২৬ জেং জুয়েমিনকে বিয়ে করেন। 


লেনিনের আদর্শ ও হো চি মিন

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যখন ফ্রান্সে বসবাস শুরু করেন, ঠিক তখনই তিনি ধীরে ধীরে আকৃষ্ট হন মার্কসবাদী লেনিনবাদী মতাদর্শে। কীভাবে তিনি লেনিনবাদের | প্রতি আকৃষ্ট হলেন, তা নিজেই লিখেছেন- “গোড়ার দিকে, সাম্রাজ্যবাদ নয়, দেশপ্রেমই আমাকে লেনিন ও তৃতীয় আন্তর্জাতিকের প্রতি বিশ্বাসী করে তুলেছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সংগ্রামে, মার্কসবাদ, লেনিনবাদ অধ্যয়ন আর তাঁর পাশাপাশি বাস্তব কার্যকলাপে অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমি এই সত্যকে উপলব্ধি করতে পারি যে, কেবল সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদই সমস্ত বিশ্বের নিপীড়িত জাতি এবং শ্রমজীবী জনগণকে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দিতে পারে।” অনেক সংগ্রামের পর ভিয়েতনামে ফরাসি শাসন শেষ হয় ১৯৫৪ সালে। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের ২০ বছরের দখলদারিত্বের অবসান ঘটে ১৯৭৩ সালে এবং উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম একত্র হয়ে সাম্যবাদী রাষ্ট্র হিসেবে ভিয়েতনামের অভ্যুদয় হয় ১৯৭৬ সালে। 


না ফেরার দেশে হো চি মিন

মহান এ নেতা ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৬৯ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ৭৯ বছর বয়সে পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। তিনি যদিও তাঁর জীবনকালে নিজ দেশের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি। এখন নিশ্চয়ই মৃত্যুর ওপারে দাঁড়িয়ে হাস্যোজ্জ্বল সেই মহান নেতা যখন দেখেন তাঁর দেশের মানুষ স্বাধীনভাবে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে বেঁচে আছে তখন তিনি নিশ্চয়ই আনন্দিত হন। কমরেড হো চি মিন আজও দুনিয়ার | শোষিত-নিপীড়িত মানুষের কাছে অসামান্য প্রেরণা।


Post a Comment

0 Comments

Close Menu