Ad Code

Responsive Advertisement

সামাজিক সুরক্ষায় সর্বজনীন পেনশন

১৮-৫০ বছর বয়সি বাংলাদেশি নাগরিকের জন্য সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাংলাদেশের বাইরে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্যও এ সুবিধা রাখা হবে। শুরুর দিকে এ ব্যবস্থা ঐচ্ছিক রাখা হলেও পরবর্তী সময়ে এটাকে বাধ্যতামূলক করা হবে। শুধু ব্যক্তিপর্যায় নয়, পদ্ধতিটির আওতায় আসতে পারবে প্রতিষ্ঠানও। তবে | সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিরা আপাতত এ নতুন পেনশন ব্যবস্থার বাইরে থাকবেন।


পেনশন কী? 

ল্যাটিন pensio শব্দ থেকে ইংরেজি pension শব্দের উৎপত্তি, যার অর্থ অবসরভাতা বা পূর্ণ মেয়াদশেষে চাকরিজীবীকে প্রদত্ত বেতনভিত্তিক কল্যাণমূলক ভাতা। অর্থাৎ, অবসরভাতা এমন একটি তহবিল যেখানে কোনো কর্মীর চাকরিতে নিযুক্ত থাকাকালীন কিছু পরিমাণ অর্থ আলাদা করে যোগ করা হয় এবং যা থেকে পর্যায়ক্রমিক আকারে ব্যক্তির অবসর গ্রহণের পরে সহায়তা প্রদানের জন্য অর্থ প্রদান করা হয়। 

পেনশনের ইতিহাস 

রোমান সম্রাট অগাস্টাস সিজার প্রাচীন রোমে প্রথম সৈনিকদের জন্য পেনশন ব্যবস্থা চালু করেন। তখন সম্রাটের গঠিত একটি বিশেষ তহবিল থেকে অবসরপ্রাপ্ত সৈন্যদের অর্থসহায়তা প্রদান করা হতো। তবে তা ছিল কেবল সৈন্যদের বিদ্রোহ দমনের একটি কৌশল। সামাজিক নিরাপত্তা হিসেবে পেনশনের ধারণাটি আসে আরও পরে। উনিশ শতকে এসে পেনশন ব্যবস্থা সেনাবাহিনীর বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। উনিশ শতকের শেষের দিকে রাষ্ট্রব্যবস্থায় আধুনিক পেনশন প্রথম চালু হয় জার্মানিতে, যা চালু করেন তৎকালীন জার্মান চ্যান্সেলর অটোভন বিসমার্ক। ১৮৮১ সালে জার্মান পার্লামেন্টে বিসমার্ক বলেন, যাদের বয়স হয়ে গেছে বা যারা অসুস্থ, তারা নিজেদের ব্যয় নির্বাহের জন্য রাষ্ট্রের কাছ থেকে ভাতা পাবেন।

সর্বজনীন পেনশন 

সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার আওতায় গঠিত তহবিলে যারা যে পরিমাণ চাঁদা দেবেন, ঐ তহবিলে একই পরিমাণ চাঁদা সরকারও দেবে। এটি ব্যবস্থাপনার জন্য আলাদা একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে। এই কর্তৃপক্ষ পেনশন তহবিল বিভিন্ন জায়গায় বিনিয়োগ করবে। বিনিয়োগ থেকে যে মুনাফা আসবে, তা-ও পেনশনধারীদের মধ্যে বিতরণ করা হবে। নতুন এ ব্যবস্থাটি চালুর আগে আইন ও বিধি প্রণয়ন এবং আলাদা একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করা হবে। বেসরকারি পর্যায়ে সব নাগরিক এ স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। সেক্ষেত্রে সুবিধাভোগীর জাতীয় পরিচয়পত্র থাকতে হবে। এই পরিচয়পত্রের নম্বর দিয়ে পৃথক একটি অ্যাকাউন্ট (হিসাব) খোলা হবে। যেখানে পেনশন পাওয়ার আগের দিন পর্যন্ত টাকা জমা দিতে হবে। সাধারণ হিসাবে দেখা গেছে, সর্বজনীন পেনশন স্কিমে একজন মানুষ তার সক্ষমতা অনুযায়ী, প্রতি মাসে ৫০০, ১০০০, ১৫০০, ২০০০, ২৫০০, ৩০০০, ৩৫০০ ও ৪০০০ টাকা অ্যাকাউন্টে জমা করতে পারবেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২১ সালের খসড়া হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সি মানুষের সংখ্যা প্রায় ৮ কোটি ৪৬ লাখ ৫৯ হাজার ৫১০। এর মধ্যে সরকারি চাকরিজীবী ১৪ লাখের বেশি। তাদের বাদ দিলে আগামী এক বছরে সরকার প্রায় ৮ কোটি ৩২ লাখের বেশি মানুষকে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার আওতায় আনতে চায় । 

পেনশনের প্রয়োজনীয়তা 

দেশের বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় বৃদ্ধকালীন সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতীয়ভাবে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি চালু করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের তোরণে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে অর্থাৎ ‘রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি' শীর্ষক অধ্যায়ের ১৫ নম্বর অনুচ্ছেদে একজন নাগরিকের মৌলিক প্রয়োজনগুলো নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে। সেই আলোকে এ পেনশন ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এতে বলা হয় যে, 'রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব, হবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তির ক্রমবৃদ্ধিসাধন এবং জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মানের দৃঢ় উন্নতিসাধন, যাতে নাগরিকদের জন্য নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ অর্জন নিশ্চিত করা যায় : অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা; কর্মের অধিকার, অর্থাৎ কর্মের গুণ ও পরিমাণ বিবেচনা করে যুক্তিসঙ্গত মজুরির বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার; যুক্তিসঙ্গত বিশ্রাম, বিনোদন ও অবকাশের অধিকার; এবং সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্ব কিংবা বিধবা, মাতাপিতাহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কারনে নতুবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত কারণে অভাবগ্রস্ততার নিমিত্তে সরকারি সাহায্য লাভ করার অধিকার।

বৈশ্বিক পেনশন ব্যবস্থা 

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরই মধ্যে কার্যকর করা হয়েছে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা। তবে পেনশন ব্যবস্থার উৎকর্ষে বিভিন্ন দেশের মধ্যে রয়েছে বিস্তর তারতম্য। বর্তমানে বিশ্বের সর্বোত্তম পেনশন ব্যবস্থা পরিচালনার খ্যাতি অর্জন করেছে আইসল্যান্ড। ভালো করছে নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, ইসরায়েল, অস্ট্রেলিয়া, নরওয়ে, নিউজিল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, কানাডা, জার্মানি, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি দেশ। সুদক্ষ ব্যবস্থাপনা, সুশাসন, বয়স্ক সব জনগোষ্ঠীকে পর্যাপ্ত অবসর সুবিধার আওতায় আনা, রাষ্ট্রীয় উদার আর্থিক সমর্থন নিশ্চিতের কারণেই দেশগুলো বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হচ্ছে। এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। দেশটির কয়েকটি রাজ্যে কার্যকরভাবে পরিচালিত হচ্ছে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা। ভুটানেও জনস্বার্থে সরকারি কর্মচারী এবং অন্যান্য পেশাজীবীদের জন্য পেনশন তহবিল চালু করা হয়েছে। তবে এখনো এ কার্যক্রম সুশৃঙ্খলভাবে দাঁড়াতে পারেনি। নেপালে জনকল্যাণার্থে স্বাস্থ্যসেবা এবং অবসরপ্রাপ্ত লোকদের জন্য সাধারণ পেনশনের ব্যবস্থা রয়েছে।

পেনশন প্রদান ব্যবস্থা 

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার খসড়া অনুযায়ী, প্রতিটি নাগরিকের জন্য একটি পেনশন অ্যাকাউন্ট থাকবে। কেউ চাকরি পরিবর্তন করলেও পেনশন হিসাব অপরিবর্তিত থাকবে। মাসিক সর্বনিম্ন জমার অর্থ নির্ধারিত থাকবে। তবে প্রবাসীরা ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে অর্থ জমা দিতে পারবেন । অর্থ জমা দিতে ব্যর্থ হলে হিসাব সাময়িক বন্ধ থাকবে। পরে জরিমানাসহ বকেয়া দিয়ে হিসাব চালু করতে পারবেন। কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দিলে নাগরিকরা পেনশন পাওয়ার যোগ্য হবেন। ৬০ বছর পূর্তিতে নাগরিকরা নির্ধারিত হারে পেনশন পাবেন। ৮০ বছর বয়স পর্যন্ত তারা পেনশন সুবিধা পাবেন। ৮০ বছর বয়সের আগে কেউ মারা গেলে নমিনি পেনশন সুবিধা পাবেন। তবে জমাকারীর অবর্তমানে এককালীন টাকা তোলার সুযোগ থাকবে না। খসড়া অনুযায়ী, আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পেনশনের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ হিসেবে উত্তোলন করা যাবে। এ জন্য সুদ গুনতে হবে । কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার আগে নিবন্ধিত চাঁদা প্রদানকারী মৃত্যুবরণ করলে জমাকৃত অর্থ মুনাফাসহ তার নমিনিকে ফেরত দেওয়া হবে। পেনশনের জন্য নির্ধারিত জমা দেওয়া অর্থ বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করে কর রেয়াতের জন্য বিবেচিত হবে এবং মাসিক পেনশন বাবদ প্রাপ্ত অর্থ আয়করমুক্ত থাকবে। এ ব্যবস্থা স্থানান্তরযোগ্য ও সহজগম্য। অর্থাৎ কর্মী চাকরি পরিবর্তন বা স্থান পরিবর্তন করলেও তার অবসর হিসাবের, স্থিতি, চাঁদা ও অবসর সুবিধা অব্যাহত থাকবে। দরিদ্র নাগরিকদের ক্ষেত্রে পেনশন স্কিমে মাসিক জমার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসেবে দিতে পারে। পেনশন কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ব্যয় সরকার নির্বাহ করবে।

পেনশনের পরিমাণ 

অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, কেউ ১৮ বছর বয়স থেকে প্রতি মাসে এক হাজার টাকা জমা দিলে ১০ শতাংশ মুনাফা এবং আনুতোষিক ৮ শতাংশ হিসাব ধরে ৬০ বছর বয়সের পর ৮০ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতি মাসে ৬৪, ৭৭৬ টাকা পেনশন পাবেন। কেউ ৩০ বছর বয়সে অর্থ জমা দেওয়া শুরু করে ৬০ বছর পর্যন্ত অব্যাহত রাখলে অবসরের পর প্রতি মাসে ১৮,৯০৮ টাকা পেনশন পাবেন। তবে চাঁদার পরিমাণ এক হাজার টাকার বেশি হলে আনুপাতিক হারে পেনশনের পরিমাণও বেশি হবে।

সার্বজনীন পেনশন বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ 

সামাজিক সুরক্ষা বিবেচনায় সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তবে এটি বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিপুলসংখ্যক মানুষের নামে পৃথক হিসাব খোলা, সেটি স্বচ্ছতার সঙ্গে পরিচালনা করা, প্রত্যেক সুবিধাভোগীর নামে বছরের প্রথমে পেনশন হিসাব বিবরণী প্রেরণ, প্রতি মাসে পেনশন বিতরণ করা এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। বর্তমানে দেশে বিভিন্ন ধরনের অবসর সুবিধার বিধান রয়েছে। যেমন সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তারা অবসরে যাওয়ার পর নিয়মিত শতভাগ পেনশন পান। অনেক স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পেনশন সুবিধা না থাকলেও রয়েছে প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্র্যাচুইটির সুবিধা। আনুষ্ঠানিকভাবে নিবন্ধিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও আছে এ ধরনের সুবিধা। বাকিদের কোনো অবসর সুবিধাই নেই। এ রকম ভিন্ন ভিন্ন ধরনের পেনশন সুবিধা বহাল রেখে সর্বজনীন পেনশন চালু করা অনেক দুরূহ। আমাদের দেশে সামাজিক নিরাপত্তা অত্যন্ত সীমিত ও দুর্বল। সরকারি কিছু উদ্যোগ ছাড়া এখানে অন্যান্য পদ্ধতি যেমন পেনশন, ইন্স্যুরেন্স, বিশেষ করে বেসরকারি খাতের জন্য নেই বললেই চলে। এ অবস্থায় সর্বজনীন পেনশনের উদ্যোগ অত্যন্ত দূরদর্শী পরিকল্পনা।

এক নজরে সার্বজনীন পেনশন:
সর্বজনীন পেনশন


Post a Comment

0 Comments

Close Menu