Ad Code

Responsive Advertisement

উচ্চশিক্ষার সোপান বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎপত্তির ইতিহাস

উচ্চশিক্ষার সোপান বিশ্ববিদ্যালয়

শিক্ষার ক্ষেত্র হিসেবে প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকের পর বিশ্ববিদ্যালয়। উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যাচর্চার প্রতিষ্ঠানকে বলে বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে একদিকে যেমন জ্ঞান বিতরণ করা হয়, অন্যদিকে তেমন নতুন জ্ঞান সৃষ্টির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গ্রহণের শাখাগুলো সাধারণত মানবিক, সমাজতত্ত্ব, বিজ্ঞান, বাণিজ্য, কৃষি, আইন, চারুকলা, প্রযুক্তি, চিকিৎসা প্রভৃতি শৃঙ্খলা বা অনুষদে বিভক্ত করা হয়ে থাকে।

 

বিশ্ববিদ্যালয়

বিশ্ববিদ্যালয় নামের উৎপত্তি: 

বাংলা ভাষায় ‘বিশ্ববিদ্যালয়' শব্দটি এসেছে ইংরেজি University থেকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্ববিদ্যালয় শব্দ নিয়ে বলেন, 'ইউরোপীয় ভাষায় যাকে ইউনিভার্সিটি বলে প্রধানত তার উদ্ভব ইউরোপে অর্থাৎ, ইউনিভার্সিটির যে চেহারার সঙ্গে আমাদের আধুনিক পরিচয় এবং যার সঙ্গে আধুনিক শিক্ষিত সমাজের ব্যবহার সেটা সমূলে ও শাখা-প্রশাখায় বিলেতি [রবীন্দ্রনাথ, ২০১০ : ১৭২]। এ থেকে অনুমান করা যায় উনিশ শতকে বাংলায় ‘বিশ্ববিদ্যালয়' শব্দের আমদানি করা হয়। আবার ইংরেজি University শব্দটি ল্যাটিন ‘ইউনিভার্সিতাস' (Universitas) শব্দের কৃতঋণ অনুবাদ। মজার বিষয় হলো বিদ্যা, বিদ্যায়তন বা উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ল্যাটিন ইউনিভার্সিতাস শব্দের ন্যূনতম যোগসূত্রও ছিল না। ইউনিভার্সিতাস শব্দের মূল অর্থ একত্রকরণ, সংঘ, সমিতি বা গিল্ড। মধ্যযুগে নাপিত থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশাজীবীর সংঘ বা গিল্ড ইউনিভার্সিতাস নামে অভিহিত হতো। মধ্যযুগের দ্বিতীয় পর্বের শুরুর দিকে (একাদশ-দ্বাদশ শতক) ইউরোপে ছাত্র ও শিক্ষকদের ইউনিভার্সিতাস (গিল্ড) গড়ে ওঠে। দ্বাদশ শতকের শেষ ও ত্রয়োদশ শতকের শুরুর দিকে ইউনিভার্সিতাস শব্দের একটি অর্থ ছিল— শিক্ষক বা শিক্ষার্থীদের সমিতি। ক্রমে এই অর্থই ইউনিভার্সিতাস শব্দের একক অর্থ হয়ে যায়।


ইতিহাসে বিশ্ববিদ্যালয়: 

আল-কারুইন (al-Quarwiyyin) বিশ্ববিদ্যালয় পৃথিবীর বুকে গড়ে ওঠা বিখ্যাত একটি বিশ্ববিদ্যালয়। মরক্কোর ফেজে গড়ে ওঠা এটি প্রাচীন সময়ের উচ্চশিক্ষা কেন্দ্র যা এখনো চালু রয়েছে। এটি ৮৫৭-৮৫৯ সালে ফাতিমা আল ফিহরি দ্বারা একটি মসজিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পরবর্তীকালে ঐতিহাসিক মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রধান আধ্যাত্মিক ও শিক্ষাকেন্দ্র হয়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয়টিকে ১৯৬৩ সালে মরক্কোর আধুনিক রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ঐতিহাসিকভাবে ইউরোপীয় চার্চগুলোতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা প্রদান করা হতো। মধ্যযুগে ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছিল অনেকটা ধর্ম ও ধর্মতত্ত্ব পড়ানোর কেন্দ্র। যেমন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ছিল চার্চের মতো। এটি ব্রিটেনে প্রতিষ্ঠিত হয় ১০৯৬ সালে। কিন্তু মধ্যযুগে ইউরোপে যখন নগররাষ্ট্র সৃষ্টি হতে শুরু করে তখন প্রশাসনিক এবং বিচার ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের প্রয়োজন পড়ে। তখন আইন ও বিচার ব্যবস্থারও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য ইউরোপের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে ছাত্ররা। ইতালির প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় ‘ইউনিভার্সিটি অব বোলোংগা', যা ১০৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় বিকাশের শুরুর দিকে ইউনিভার্সিটি শব্দটি কোনো দলিলে ব্যবহৃত হতো না। তবে ছাত্র বা শিক্ষকসংঘ ইউনিভার্সিটি নামেই পরিচিত ছিল। একসময় ইউনিভার্সিটি শব্দের অর্থ তৈরি হয়— ডিগ্রি প্রদানে সক্ষম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।



উপমহাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়: 

পৃথিবীর প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে নালন্দা। খ্রিষ্টীয় ৪২৭ অব্দে নালন্দা বিহার প্রতিষ্ঠা করা হয় মগধে, যা বর্তমানে ভারতের বিহার রাজ্যে অবস্থিত। পরবর্তীতে আনুমানিক অষ্টম শতকের দিকে বিক্রমশীলা, সোমপুর এবং ওদন্তপুরী মহাবিহার প্রতিষ্ঠা করেন ধর্মপাল। সোমপুর বর্তমানে বাংলাদেশের পাহাড়পুরে অবস্থিত। নালন্দা সম্পর্কে সবচেয়ে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় হিউয়েন সাঙের ভ্রমণ কাহিনীতে এবং তিব্বতীয় সূত্র সাহিত্য থেকে। ধারণা করা হয় আনুমানিক সপ্তম শতকের দিকে নালন্দা সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে যায়। সে সময়ে নালন্দায় ১০,০০০ শিক্ষার্থী এবং ২,০০০ শিক্ষক ছিলেন। যদিও হিউয়েন সাঙের অবস্থানকালে ৬,০০০ শিক্ষার্থী ছিল। তাদের অনেকে কোরিয়া, জাপান, চীন, তিব্বত, ইন্দোনেশিয়া, ইরান এবং তুরস্ক থেকে আগত । দ্বাদশ শতাব্দীতে তুর্কী সেনাবাহিনীর হাতে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগে এই নালন্দা ছিল এশিয়া মহাদেশে সবচেয়ে বিখ্যাত জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র। ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪ পুনরায় চালু করা হয় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। ভারতের নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের নেতৃত্বে কিছু বিদ্বান ব্যক্তি বিশ্ববিদ্যালয়টি পুনর্গঠন করেন।



বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়: 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের তথা পূর্ব বাংলার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। ১ জুলাই ১৯২১ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। বঙ্গভঙ্গের সময় থেকে পূর্ববঙ্গে মুসলিম সমাজে যে নবজাগরণ শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তারই ফল। ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে শুরু থেকে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহর। তার নেতৃত্বে একদল মুসলিম জনপ্রতিনিধি বঙ্গভঙ্গ রদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানান সর্বপ্রথম ৩১ জানুয়ারি ১৯১২। এ দাবিকে সম্মান জানিয়ে লর্ড কার্জন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সম্মতি দেন। ২৭ মে '১৯১২ এ লক্ষ্যে ১৩ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠিত হয় স্যার রবার্ট নাথানিয়েলের নেতৃত্বে, যা ‘নাথান কমিটি' নামে পরিচিত। ১৯১৩ সালে নাথান কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হয় এবং একই বছরের ডিসেম্বরে তা অনুমোদন লাভ করে। কিন্তু, ১৯১৫ সালে নবাব স্যার সলিমুল্লাহর আকস্মিক মৃত্যু ঘটলে নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী শক্ত হাতে এই উদ্যোগের হাল ধরেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তৎকালীন পূর্ব বাংলার হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে ঢাকার বালিয়াটির জমিদার ছিলেন অন্যতম। ১৯১৭ সালের নভেম্বরে ইংরেজ সরকার ‘স্যাডলার কমিশন' গঠন করে পূর্ববর্তী ‘নাথান কমিশনের রিপোর্টকে পর্যালোচনা করে ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিষয়গুলোকে বিবেচনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে নতুন করে রিপোর্ট দিতে বলেন। এই 'স্যাডলার কমিশন’ তাদের রিপোর্ট প্রদান করে ১৯১৯ সালে। ১৩ মার্চ ১৯২০ ভারতীয় আইন সভায় ‘দ্যা ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট ১৯২০' অনুমোদিত হয়। গভর্নর জেনারেল সেই আইনে স্বাক্ষর করেন ২৩ মার্চ। স্যাডলার কমিশনের অন্যতম সদস্য, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক রেজিস্ট্রার স্যার ফিলিপ জোসেফ হার্টগ ১ ডিসেম্বর ১৯২০ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান। স্যার সলিমুল্লাহর দান করা ৬০০ একর জমির ওপর বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। তখন কলা, বিজ্ঞান ও আইন— এই তিনটি অনুষদের আওতায় ১২টি বিভাগ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১ জুলাই ১৯২১ তার যাত্রা শুরু করে। শুরুতে আবাসিক হলের সংখ্যা ছিল তিনটি শিক্ষক ছিলেন ৬০ জন, আর প্রথম ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৮৭৭ জন। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয়টি হলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। ৬ জুলাই ১৯৫৩ বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করা হয়। আয়তনে দেশের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয় হলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ২১১০ একরের এই বিশ্ববিদ্যালয়টি ১৮ নভেম্বর ১৯৬৬ প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতার পূর্বে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ৬টি। স্বাধীনতার পর প্রথম প্রতিষ্ঠা করা হয় কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটি। বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৫০টি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ১০৮টি ও আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় ২টি। বাংলাদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর বা আচার্য বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি।


মোট সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৫০টি 

প্রথম— ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 

৫০তম- শেখ হাসিনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় 

প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় >  

প্রথম-- বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। 

শেষ— খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় 

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় >  

প্রথম— শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। 

শেষ— চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় 


মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় > 

প্রথম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় । 

শেষ— শেখ হাসিনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় 


কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় > 

প্রথম — বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় | 

শেষ — হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় । 




(তথ্যসূত্র: মাসিক কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স-৩০৬, ফেব্রুয়ারী-২০২২)

Post a Comment

0 Comments

Close Menu