Ad Code

Responsive Advertisement

ইসরায়েল - ফিলিস্তিন সংকট এ যুদ্ধের শেষ কোথায় ?

ইসরায়েল - ফিলিস্তিন যুদ্ধের শেষ কোথায় ?


জেরুজালেম, পবিত্র মসজিদ আকসা। কুরআনুল কারিমের সূরা বনি ইসরাইলের ১নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে ‘পবিত্র মহান সেই সত্তা, যিনি তাঁর বান্দাকে এক রাতে তাঁর কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখানোর জন্য নিয়ে যান (মক্কার)। মসজিদুল হারাম থেকে (জেরুজালেমের) বরকতময় পরিবেশপূর্ণ মসজিদুল আকসায়। তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বশ্রেষ্ঠ। 

মসজিদ আকসা


জেরুজালেমের পবিত্র মসজিদ যা বায়তুল মুকাদ্দাস বা মসজিদুল আকসা নামে পরিচিত, মুসলমানদের কাছে খুবই সম্মানিত। পবিত্র কোরআনের ওপরে উল্লিখিত আয়াতে এই মসজিদের কথা বলা আছে। আমাদের প্রিয় নবীজি (স.) মিরাজের রাতে মসজিদুল হারাম তথা কাবা শরিফ থেকে মসজিদুল আকসা তথা বায়তুল মুকাদ্দাসে ভ্রমণ করেন যা ‘ইসরা বা রাতের ভ্রমণ হিসেবে পবিত্র কোরআনে এসেছে। প্রিয় নবী (স.) মিরাজে গমনের সময় সব নবী-রাসূলকে নিয়ে এই মসজিদে নামাজ পড়েছেন। নামাজে তিনি ইমামতি করেন। এ জন্য মহানবী (স.) ইসামুল আম্বিয়া, সাইয়্যিদুল মুরসালিন বা সব নবী রাসূলের সর্দার হিসেবে স্বীকৃত। জেরুজালেমের এ এলাকা বহু নবী-রাসূলের স্মৃতিবিজড়িত। এখানে তাদের কবর রয়েছে। ফলে প্রতিটি মুসলমানের হৃদয়ে এ পবিত্র ভূমির প্রতি ভালোবাসা বিদ্যমান রয়েছে।


হজরত আবুজর গিফারি (র.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (স.) কে জিজ্ঞাসা করলাম, বিশ্বের সর্বপ্রথম মসজিদ কোনটি? তিনি বললেন, ‘মসজিদুল হারাম'। তারপর বললাম, এরপর কোনটি? তিনি বললেন, ‘মসজিদুল আকসা'। আমি জিজ্ঞেস করলাম এই দুই মসজিদের নির্মাণের মধ্যে কত দিনের ব্যবধান রয়েছে? তিনি বললেন, ‘৪০ বছর'। 


অর্থাৎ কাবাঘর নির্মাণের ৪০ বছর পর ‘আল আকসা' মসজিদটি নির্মিত হয়। হজরত ইব্রাহিম (আ.) কাবাঘর নির্মাণ করেন। তার পুত্র হজরত ইসহাক (আ.)-এর সন্তান হজরত ইয়াকুব (আ.) ফিলিস্তিনের জেরুজালেম নামক স্থানে ‘আল আকসা মসজিদ নির্মাণ করেন। এরপর তার ছেলে হজরত ইউসুফ (আ.) এবং বংশধর হজরত দাউদ (আ.)-এর সন্তান হজরত সুলাইমান (আ.) আল আকসা মসজিদটি পুনঃনির্মাণ করেন। একই সাথে তিনি রমজানমাসের শেষ শুক্রবার জেরুজালেম নগর প্রতিষ্ঠা করেন। 


কাবা শরিফ প্রথমে কিবলা থাকলেও মসজিদুল আকসা নির্মিত হলে এটিই কিবলা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। মহানবী (সা.)-এর হিজরতের দেড় বছর পর এ কিবলা পরিবর্তন হয়ে কাবা শরিফ কিবলা হিসেবে নির্ধারিত হয়ে ওহি নাজিল হয়। মদিনার যে মসজিদে নবীজি (স.)-এর নামাজরত অবস্থায় কিবলা পরিবর্তন হয় সে মসজিদের নাম মসজিদে কিবলাতাইন। 


মহানবী (স.)-এর হাদিসে বলা হয়েছে- একমাত্র তিনটি মসজিদেই জিয়ারতের নিয়তে যাওয়া যায়। মসজিদুল হারাম, মসজিদে নববী ও মসজিদুল আকসা। এর মধ্যে মসজিদুল হারামে নামাজ পড়লে এক লক্ষগুণ সওয়াব, মসজিদে নববীতে ৫০ হাজার গুণ সওয়াব, মসজিদুল আকসায় ২৫ হাজার গুণ সওয়াব হয়। দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর (রা.)-এর সময়ে ৬৪৮ সালে বায়তুল মুকাদ্দাস, জেরুজালেমসহ পুরো ফিলিস্তিন সম্পূর্ণরূপে মুসলমানদের অধিকারে আসে। 


১০৯৬ সালে খ্রিস্টান ক্রুসেডাররা সিরিয়া ও ফিলিস্তিন জবরদখল করে নেয়। ১১৮৭ সালে মুসলিম বীর সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবি রহ. পুনরায় জেরুজালেম শহর মুসলমানদের অধিকারে নিয়ে আসেন। এরপর থেকেই খ্রিস্টান ও ইহুদি চক্র ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র করতে থাকে। সুকৌশলে ফিলিস্তিনে ইহুদি সংখ্যা বাড়াতে থাকে।আড়াইশ' বছর ফিলিস্তিন মিশরের একটি প্রদেশ ছিল। এরপর এটি অটোম্যান সাম্রাজ্যের অধীন হয়। 


প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোম্যানদের পরাজয়ের পর ব্রিটেন ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ নেয়। তখন ফিলিস্তিনে বসবাসকারীদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠরা ছিল আরব মুসলমান এবং সংখ্যালঘু ছিল ইহুদি। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে থাকায় পশ্চিমা সম্প্রদায় ব্রিটেনকে দায়িত্ব দেয় ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার। আরবদের দাবি এই ভূমি তাদের। কিন্তু ইহুদিরা দাবি করে এই ভূমি তাদের পূর্ব পুরুষদের। ইহুদিরা বিশ্বাস করে বাইবেলে বর্ণিত পিতৃপুরুষ আব্রাহাম এবং তার বংশধরদের জন্য যে পবিত্রভূমির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, আজকের আধুনিক ইসরায়েল সেখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রাচীনকাল থেকেই অবশ্য এই ভূমি নিয়ে সংঘাত চলছে। 


আসিরিয়ান, ব্যাবিলোনিয়ান, পার্সিয়ান, ম্যাসিডোনিয়ান এবং রোমানরা সেখানে অভিযান চালিয়েছে, সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে। রোমানরা সেখানে ‘জুডো' বলে একটি প্রদেশ তৈরি করেছিল। তবে এই ‘জুডো' প্রদেশের ইহুদিরা বেশ কয়েকবার বিদ্রোহ করেছেন। রোমান সম্রাট হাড্রিয়ানের আমলে ১৩৫ খ্রিস্টাব্দে এক বিরাট জাতীয়তাবাদী ইহুদি বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল। তিনি তা দমন করেন। এরপর তিনি জুডো এবং রোমানদের অধীন সিরিয়াকে যুক্ত করে তৈরি করেন এক নতুন প্রদেশ, যার নাম দেওয়া হয় সিরিয়া-প্যালেস্টাইন। 


এসব যুদ্ধ-বিগ্রহের ফলে সেখানে ইহুদিদের সংখ্যা মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়। সেখানে ইহুদিদের ব্যাপক হারে হত্যা করা হয়। অনেকে নির্বাসিত হয়। অনেক ইহুদিকে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয়। অষ্টম শতকে যখন ইসলামের উত্থান ঘটলো, প্যালেস্টাইন জয় করলো আরবরা। এরপর অবশ্য ইউরোপীয় ক্রুসেডাররা সেখানে অভিযান চালায়। ১৫১৬ সালে এই এলাকায় শুরু হয় তুর্কি আধিপত্য। এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত এই অঞ্চলটি একনাগাড়ে শাসন করেছে তারা। 


বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ইউরোপে বসবাসকারী ইহুদিরা ব্যাপক বিদ্বেষ-নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। সেখান থেকেই ‘জাওনিজম' বা ইহুদিবাদী আন্দোলনের শুরু। তাদের লক্ষ্য ছিল ইউরোপের বাইরে কেবল ইহুদিদের জন্য একটি রাষ্ট্র পত্তন করা। সেই সময় প্যালেস্টাইন বা ফিলিস্তিন ছিল তুর্কি অটোম্যান সাম্রাজ্যেরঅধীন। এটি মুসলিম, ইহুদি এবং খ্রিস্টান- এই তিন ধর্মের মানুষের কাছেই পবিত্র ভূমি হিসেবে বিবেচিত। ইহুদিবাদী আন্দোলন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ইউরোপের ইহুদিরা দলে দলে প্যালেস্টাইনে গিয়ে বসত করতে শুরু করে। কিন্তু তাদের এই অভিবাসন স্থানীয় আরব এবং মুসলিমদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করে। সেসময় আরব এবং মুসলিমরাই ছিল সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ।


প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তুর্কি অটোম্যান সাম্রাজ্য কার্যত ভেঙে পড়ে। তখন যে 'লিগ অব নেশন' গঠিত হয়েছিল, সেই বিশ্ব সংস্থার পক্ষ থেকে ব্রিটেনকে ‘ম্যান্ডেট' দেওয়া হয় প্যালেস্টাইন শাসন করার। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যখন চলছিল তখন ব্রিটেন আরব এবং ইহুদি উভয় পক্ষের কাছেই নানা রকম প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল প্যালেস্টাইন নিয়ে। কিন্তু এসব প্রতিশ্রুতির কোনোটিই ব্রিটেন রক্ষা করেনি। পুরো মধ্যপ্রাচ্য তখন কার্যত ভাগবাঁটোয়ারা করে নিয়েছিল ব্রিটেন আর ফ্রান্স। এই দুই বৃহৎ শক্তি পুরো অঞ্চলকে তাদের মতো করে ভাগ করে নিজেদের প্রভাব বলয়ে ঢোকায়। 


১৯২০-১৯৪০ এর দশকে ইউরোপ থেকে দলে দলে ইহুদি আসতে থাকে ফিলিস্তিনে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের ইহুদি নিধনযজ্ঞের সময়ও অনেক ইহুদি পালিয়ে এখানে আসে। প্যালেস্টাইনে তখন আরব জাতীয়তাবাদী এবং ইহুদিবাদীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত শুরু হয়। ইহুদি এবং আরব মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলো পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে। এদিকে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যেভাবে লাখ লাখ ইহুদিকে হত্যা করা হয় (হলোকাস্ট) তারপর ইহুদিদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় চাপ বাড়তে থাকে। 


কিন্তু আরব আর ইহুদিদের মধ্যে এ নিয়ে যে বিরোধ, ব্রিটিশরা তার কোনো সমাধান করতে পারছিল না। তারা বিষয়টি নিয়ে যায় জাতিসংঘে পুরো বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখার জন্য জাতিসংঘ একটি বিশেষ কমিশন গঠন করে। ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ প্যালেস্টাইন ভাগ করার এক পরিকল্পনা অনুমোদন করে। ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অধীনে থাকা অঞ্চলটি তখন ফিলিস্তিনি আর ইহুদিদের মধ্যে ভাগ করার সিদ্ধান্ত হয়। এই পরিকল্পনায় একটি আরব এবং একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা ছিল আর জেরুজালেম নগরীর জন্য একটি বিশেষ কৌশল গ্রহণের কথা বলা হয়। পরিকল্পনাটি মেনে নিয়েছিল ইসরায়েল, কিন্তু প্রত্যাখ্যান করেছিল আরবরা। এই পরিকল্পনাকে আরবরা দেখছিল তাদের ভূমি কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র হিসেবে। 


প্যালেস্টাইনে ব্রিটিশ শাসন চলেছে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত। কিন্তু প্যালেস্টাইনের ওপর ব্রিটিশ ম্যান্ডেট শেষ হওয়ার মাত্র একদিন আগে পরিস্থিতি অনুকূল পেয়ে ১৪ মে ১৯৪৮ ইসরায়েল একতরফাভাবে ইসরায়েল রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয়। পরের দিনই ইসরায়েল জাতিসংঘের সদস্য হওয়ার জন্য আবেদন জানালো, যা গৃহীত হলো এক বছর পর। জাতিসংঘের ১৯৩টি দেশের ১৬০টি ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছে।


ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরদিনই মিশর, জর্দান, সিরিয়া এবং ইরাক মিলে অভিযান চালায় ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অধীনে থাকা অঞ্চলে। সেটাই ছিল প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ। ইহুদিদের কাছে এটি স্বাধীনতার যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। জাতিসংঘ প্যালেস্টাইনে আরবদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় যে অঞ্চলটি বরাদ্দ করেছিল, এই যুদ্ধের পর তার অর্ধেকটাই চলে যায় ইসরায়েল বা ইহুদিদের দখলে। ফিলিস্তিনের জাতীয় বিপর্যয়ের শুরু সেখান থেকে। এটিকেই তারা বলে 'নাকবা' বা বিপর্যয়। প্রায় সাড়ে সাত লাখ ফিলিপ্তিনিকে পালিয়ে প্রতিবেশি দেশগুলোতে আশ্রয় নিতে হয়। ইহুদি বাহিনী তাদেরকে বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করে। কিন্তু আরব আর ইসরায়েলিদের মধ্যে এটা ছিল প্রথম যুদ্ধ মাত্র। 


তাদের মধ্যে এক দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতের সূচনা হলো মাত্র। ১৯৫৬ সালে যখন সুয়েজ খাল নিয়ে সংকট তৈরি হয়, তখন ইসরায়েল মিশরের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। কিন্তু সেই সংকটে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ব্রিটেন, ইসরায়েল আর ফ্রান্সকে পিছু হটতে হয়। ফলে যুদ্ধের মাঠ কোনো কিছুর মীমাংসা সেই সংকটে হয়নি। এরপর এলো ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের আরব ইসরায়েল যুদ্ধ। ৫ জুন হতে ১০ জুন পর্যন্ত এই যুদ্ধে যা ঘটেছিল, তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছিল পরবর্তীকালে। ইসরায়েল বিপুলভাবে জয়ী হয় এই যুদ্ধে। তারা গাজা এবং সিনাই উপদ্বীপ দখল করে নেয় যা কিনা ১৯৪৮ সাল হতে মিশরের নিয়ন্ত্রণে ছিল। অন্যদিকে, পূর্ব জেরুজালেমসহ পশ্চিম তীরও তারা দখল করে নেয় জর্দানের কাছ থেকে। সিরিয়ার কাছ থেকে দখল করে গোলান মালভূমি। আরও পাঁচ লাখ ফিলিস্তিনিকে তাদের বাড়িঘর ফেলে পালাতে হয়।


তারা নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে ফিলিস্তিনিদের তাড়িয়ে জবরদখল করে ইহুদি বসতি স্থাপন করে। ১৯৬৭ সালে ইসরায়েল 'মসজিদুল আকসা' জবরদখল করে। মুসলমানরা পুনরায় এই মসজিদ উদ্ধার এবং ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ঐক্যের অভাবের কারণে এখনো মসজিদুল আকসা উদ্ধার করা যায়নি। আরব-ইসরায়েল সংঘাতের ইতিহাসে এর পরের যুদ্ধটি ‘ইয়োম কিপুর’ যুদ্ধ নামে পরিচিত। ১৯৭৩ সালের অক্টোবরের এই যুদ্ধের একদিকে ছিল মিশর আর সিরিয়া, অন্যপক্ষে ইসরায়েল। মিশর এই যুদ্ধে সিনাই অঞ্চলে তাদের কিছু হারানো ভূমি পুনরুদ্ধার করে। তবে গাজা বা গোলান মালভূমি থেকে ইসরায়েলকে হটানো যায়নি। 


কিন্তু এই যুদ্ধের ছয় বছর পর ঘটলো সেই ঐতিহাসিক সন্ধি। মিশর প্রথম কোনো আরব রাষ্ট্র যারা ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করলো। এরপর তাদের পথ অনুসরণ করলো জর্দান। কিন্তু তাই বলে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধ শেষ হলো না। গাজা ভূখণ্ড যেটি বহু দশক ধরে ইসরায়েল দখল করে রেখেছিল, সেটি ১৯৯৪ সালে তারা ফিলিস্তিনিদের কাছে ফিরিয়ে দিল। সেখানে ইসরায়েলি এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যে বড়ো ধরনের লড়াই হয় ২০০৮, ২০০৯, ২০১২ এবং ২০১৪ সালে। গত ৭৩ বছর ধরে ইহুদি বসতি স্থাপন অব্যাহত রয়েছে। ফিলিস্তিনিরা তাদের জন্মভূমির স্বাধীনতার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। পূর্ব জেরুজালেম, গাজা এবং পশ্চিমতীরে যে ফিলিস্তিনিরা বসবাস করছে তাদের সাথে ইসরাইলের সংঘর্ষ চলছেই। এবার ইসরায়েল যে হামলা চালায় তা গত কয়েক বছরের মধ্যে ভয়াবহ। চলমান ঘটনার সূত্রপাত পূর্ব জেরুজালেম থেকে কয়েকটি ফিলিস্তিন পরিবারকে উচ্ছেদ করা হলেও নেপথ্য কারণ ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা চলছে। ঘুষ নেওয়ার অপরাধে তার জেলে যাওয়ার কথা। সাম্প্রতিক নির্বাচনে তারদল ভালো ফল করেনি। কোনো ইসরায়েলি নেতা বেকায়দায় পড়লে ফিলিস্তিনিদের নিশানা করে। নেতানিয়াহুও এ পথ বেছে নেন। 


শবেকদরের রাতে (১০ মে ২০২১) হামলা চালায়। এভাবেই হামলার প্রেক্ষাপট তৈরি করা হয়। ফিলিস্তিনিদের ভূমিতে জোরপূর্বক দখলদারি নিয়ে যাত্রা শুরু করে ইসরায়েল-হিব্রু বাইবেলের পুরোকথার দোহাই পেড়ে ‘ঈশ্বরের প্রতিশ্রুত ভূমিতে ফিরে আসার মধ্য দিয়ে। সেই থেকে এক অনিঃশেষ অনিশ্চয়তার মধ্যে পতিত হয় ফিলিস্তিনিরা, যা আজও চলছে। আর তাই প্রতিবছর ১৫ মে ফিলিস্তিনিরা নাকবা দিবস হিসেবে পালন করে। এবারের নাকবা দিবসও এসেছে জায়নাবাদী তথা উগ্র ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েলের ৭৩তম জন্মবার্ষিকীর পাশ ঘেঁষে। 


এসেছে গাজায় ইসরায়েলের বিমান-বোমা হামলা-নিধনযজ্ঞ আর জেরুজালেমে হারাম-আল-শরিফ প্রাঙ্গণে ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্যাতন-দমন-পীড়নের মধ্য দিয়ে। ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম থেকেই চলেছে ফিলিস্তিনিদের ওপর দমন-পীড়ন, চলছে তাদের সহায়-সম্পত্তি চুরি, ডাকাতি ও লুটপাট।


গাজা উপত্যকায় আটটি শরণার্থী শিবিরের মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম শিবিরের নাম শাতি। এখানে ৮৫ হাজার ফিলিস্তিনি শরণার্থীর বাস। এ শিবিরে হামলা চালিয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়েছে। এবার ইসরায়েল ৮০০ ফিলিস্তিনি স্থাপনায় হামলা করেছে। পশ্চিমতীরেও হামলা ছড়িয়ে পড়ে। গাজায় ১০ তলার একটি মিডিয়া টাওয়ার বিমান থেকে বোমা মেরে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এর জবাবে গাজা থেকে হামাস রকেট হামলা চালায়। ইসরায়েল ‘আয়রন ডোম' নামে এক ধরনের ভ্রাম্যমাণ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দ্বারা রকেট হামলা প্রতিহত করে। দেশে দেশে মুসলমানরা ইসরায়েলের এ বর্বর হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান বলেছেন, ইসরায়েলকে সম্মিলিতভাবে এখনই থামাতে না পারলে আল আকসা থেকে তার চোখ পড়বে কাবা শরিফে। হোয়াইট হাউজের বিবৃতিতে বলা হয়, বাইডেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন, গাজা থেকে হামাস ও অন্যান্য সন্ত্রাসী পক্ষের রকেট হামলা ঠেকাতে ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে। আর এই অধিকারের প্রতি তার একনিষ্ঠ সমর্থন অব্যাহত থাকবে। আর ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে বাইডেন বলেন, ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে গাজা থেকে হামাস যেন রকেট হামলা বন্ধ করে। 


এই হলো আমেরিকা ! প্রেসিডেন্ট বদলায় কিন্তু ইসরায়েল প্রশ্নে - আমেরিকার নীতি বদলায় না। ইসরায়েলের তথাকথিত আত্মরক্ষা নিয়েই এদের যত মাথাব্যথা। ইসরায়েল গাজায় ঝাঁকে ঝাঁকে জঙ্গি বিমান দিয়ে বোমা হামলা করে নির্বিচারে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, আমেরিকার চোখে তা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নয়, আত্মরক্ষার অধিকার। অন্যদিকে, ফিলিস্তিনিদের প্রতিবাদ তাদের চোখে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। 


এগারো দিন পর ২১ মে ২০২১ হামাস ও ইসরায়েল মিশরের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেয়। দুপক্ষই বিজয় দাবি করলেও প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ২৫০ জনের। ইরানের মরহুম ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর ঐক্যের ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেছিলেন, মুসলিম ভ্রাতৃত্ব তথা রাষ্ট্রগুলো যদি এক হয় তবে লড়াইয়ের প্রয়োজন নেই, প্রত্যেক মুসলমান যদি এক বালতি করে পানি ঢেলে দেয় তাহলেই ইসরায়েল নামের ইহুদি রাষ্ট্র তলিয়ে যাবে। তার আহ্বানেই প্রতি বছর আল কুদস দিবস পালিত হয়। আল আকসা উদ্ধারে এখন প্রয়োজন মুসলিম বিশ্বের ঐক্য।

Post a Comment

0 Comments

Close Menu