Ad Code

Responsive Advertisement

ক্ষেপণাস্ত্রের জীবন বৃত্তান্ত

ক্ষেপণাস্ত্রের এ টু জেড 

আধুনিক যুদ্ধে যেকোনো দেশের বড় হাতিয়ার হচ্ছে মিসাইল বা ক্ষেপণাস্ত্র । ক্ষেপণাস্ত্রের সূচনাই হয় ধ্বংস দিয়ে। মানুষ এটি ধ্বংসাত্মক কাজেই ব্যবহার করছে।বিশ্বে প্রভাব বজায় রাখতে নিত্যনতুন ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির চেষ্টায় রয়েছে ক্ষমতাধর দেশগুলো।


ক্ষেপণাস্ত্র


ক্ষেপণাস্ত্রের কথকতা: 

মিসাইল (Missile) বা ক্ষেপণাস্ত্র হচ্ছে রকেট চালিত দ্রুত গতির একধরনের অস্ত্র, যা বিস্ফোরক দ্রব্যসহ খুবই নির্ভুলতার সঙ্গে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে। ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সাধারণত ছোট থেকে বৃহৎ আকৃতিরও হতে পারে। এগুলো কয়েকশত ফুট থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। ক্ষেপণাস্ত্র পাঁচটি অংশ নিয়ে গঠিত— Targeting, Guidance system, Flight system, Engine Warhead I 


ক্ষেপণাস্ত্রের প্রচলন 

১৯৩৬ সালে নাৎসি জার্মানি বিশ্বের প্রথম ক্ষেপণাস্ত্র ভি-২ রকেট তৈরি করে। ৩ অক্টোবর ১৯৪২ প্রথম সফলভাবে উৎক্ষেপণ করা হয়। এটি উদ্ভাবন করেন ওয়াল্টার ডর্নবার্গার ও ওয়ার্নার ভন ব্রাউন । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি প্রথম এ রকেট ব্যবহার করে । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের পর যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এ ক্ষেপণাস্ত্র হস্তগত করে এবং তাদের নিজস্ব ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটায়। এভাবেই তৈরি হয় বর্তমান সময়ের ICBM, MRBM ও SRBMসহ বিভিন্ন প্রজাতির ক্ষেপণাস্ত্র । বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র R-36M, যা রাডার ফাঁকি দিয়ে মাত্র ৩৫ মিনিটে ১৬,০০০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম।


ক্ষেপণাস্ত্রের প্রকারভেদ 

ক্ষেপণাস্ত্র সাধারণত দুই প্রকার— ক্রুজ ও ব্যালিস্টিক। আবার উৎক্ষেপণের স্থান ও ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন নামের হতে পারে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— ভূমি থেকে আকাশ, আকাশ থেকে আকাশ, ভূমি থেকে ভূমি, আকাশ থেকে ভূমি, ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী/ইন্টারসেপ্টর, সাবমেরিন থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য, ট্যাঙ্ক-বিধ্বংসী, স্যাটেলাইট বিধ্বংসী, অ্যান্টি-রেডিয়েশন, বায়ুচালিত ব্যালিস্টিক, আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ও হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র। 


ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র : 

ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র এক ধরনের গাইডেড তথা গতিনিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্র, যা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের মধ্য থেকে মোটামুটি একই গতিতে ভূ-পৃষ্ঠের কোনো লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে। এ ক্ষেপণাস্ত্র মূলত জেট ইঞ্জিন চালিত এয়ারক্রাফটের মতো কাজ করে।  


ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র : 

পদার্থবিদ্যার শাখা মেকানিক্সের ব্যালিস্টিক নীতি অনুসরণ করে সুনির্দিষ্ট বঙ্কিম পথে পূর্ব নির্ধারিত কোনো লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে তা-ই ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র । কতকগুলো অংশে বিভক্ত মিসাইল রকেট ইঞ্জিনের প্রযুক্তিতে কাজ করে, যা দূরত্ব অনুযায়ী পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল অতিক্রম করতেও পারে আবার নাও পারে। 


ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা

ক্ষেপণাস্ত্র পাল্লা
দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ৩,৫০০-৫,৫০০ কিমি.
মাঝারি বা মধ্যম পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ১,০০০-৩,৫০০ কিমি.
স্বল্পপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ৩০০-১,০০০ কিমি.


আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র: 

Intercontinental Ballistic Missile (ICBM) হলো রকেট চালিত ক্ষেপণাস্ত্র। এতে পারমাণবিক বা রাসায়নিক ওয়ারহেড যুক্ত করা হয়। ICBM'র সর্বনিম্ন পরিসীমা ৫,৫০০ কিলোমিটার (৩,৪০০ মাইল)। ভূ-পৃষ্ঠ | থেকে নিক্ষেপের পর এ ক্ষেপণাস্ত্রটি সোজা ওপরের দিকে উঠতে শুরু করে। | এটি দুই থেকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে মহাশূন্যে পৌছে যায়। মহাশূন্যে পৌঁছে | মাধ্যাকর্ষণকে কাজে লাগিয়ে অল্প সময়ে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে ক্ষেপণাস্ত্রটি। এরপর আবার তা বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে এবং লক্ষ্যবস্তু বা নিশানার ওপর নেমে আসতে শুরু করে। প্রথম রকেটের জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে তা মূল ক্ষেপণাস্ত্র থেকে আলাদা হয়ে যায় এবং দ্বিতীয় রকেটটি জ্বলতে শুরু করে। এভাবে একটি ICBM এ তিনটি পর্যন্ত রকেট যুক্ত করা যায়। পারমাণবিক | বোমাযুক্ত একটি ক্ষেপণাস্ত্র চোখের নিমেষেই ধ্বংস করে ফেলতে পারবে বিশ্বের যেকোনো শহর । বর্তমানে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ফ্রান্স, ভারত, যুক্তরাজ্য এবং | উত্তর কোরিয়ার কাছে আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে।


হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র 

শব্দের গতির চেয়ে কমপক্ষে পাঁচগুণ বেশি তথা প্রতি ঘণ্টায় ৬,১০০ কিমি. (৩,৮০০ মাইল) বেশি বেগে উড়তে পারে এমন ক্ষেপণাস্ত্রকেই সাধারণত হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র বলা হয়। হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি একেবারেই ভিন্ন। এটি উৎক্ষেপণের পর খুব দ্রুত ওপরে উঠে আবার নেমে এসে আনুভূমিকভাবে বায়ুমণ্ডলের মধ্যেই চলতে থাকে, গতিপথও পরিবর্তন করতে পারে। এর অর্থ এটি কোনদিকে যাবে তা আগে থেকে অনুমান করা সম্ভব নয়। তাই তা মাঝপথে ধ্বংস করা প্রায় অসম্ভব।


ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা

ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা (Missile Defense) এমন একটি পদ্ধতি, যা ক্ষেপণাস্ত্রের হামলা শনাক্তকরণ, বাধাদান এবং ধ্বংসের সাথে জড়িত। মূলত এটিকে আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা হিসেবে ভাবা হয়। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ভারত, ইসরায়েল ও ফ্রান্স এ জাতীয় প্রতিরক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছে।


প্যাট্রিয়ট 

যুক্তরাষ্ট্রের আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা প্যাট্রিয়ট (Patriot)। প্যাট্রিয়ট MIM 104 আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাটি ভূমি থেকে আকাশে উৎক্ষেপণযোগ্য। এটি একটি দূরপাল্লা ক্ষেপণাস্ত্র। এটি সব আবহাওয়াতে আকাশ থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র বা অন্য কোনো ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা মোকাবিলা করতে পারে। এটি ব্যালিস্টিক মিসাইল, ক্রুজ মিসাইল ও অ্যাডভান্স এয়ারক্রাফট হামলা মোকাবিলায় বেশ পারদর্শী। এর সবোর্চ্চ দূরত্ব ৭০ কিলোমিটার। তবে ২৪ কিলোমিটারের মধ্যে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। এর মাথায় ৯০ কেজি ওজনের বিস্ফোরক বহন করতে পারে।


থাড 

আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ও ভয়ংকর ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা থাড। Terminal High Altitude Area Defense (THAAD) নামের এ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা শতভাগ কার্যকর। বিশাল ট্রাকের ওপর বসানো থাকে এ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। আক্রমণের জন্য ধেয়ে আসা যেকোনো ক্ষেপণাস্ত্রকে মুহূর্তে ধ্বংস করে দিতে সক্ষম এটি। এতে ব্যবহার করা হয় কাইনেটিক এনার্জি। যার গতির মাধ্যমে ধেয়ে আসা ক্ষেপণাস্ত্রে আঘাত করা হয়। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে উত্তর কোরিয়ার হামলা মোকাবিলার জন্য ২০১৩ সাল থেকে এ প্রযুক্তি মোতায়েন করে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র।


আয়রন ডোম 

ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থার নাম ‘আয়রন ডোম'। যা তৈরি করেছে Rafayel Advanced Defense System 3 Israel Aerospace Industries। আয়রন ডোমের প্রধান তিনটি দিক রাডার সিস্টেম, কন্ট্রোল সিস্টেম ও মিসাইল ফায়ারিং। ২০০৬ সালে লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধে ইসরায়েলের জনগণের জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি রুখতে নতুন এ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলে। ২০১১ সালে ইসরায়েল প্রথম আয়রন ডোম মোতায়েন করে।


এইচকিউ-৯ 

চীনের তৈরি উচ্চ থেকে মধ্যম রেঞ্জের বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। একই সঙ্গে এটাকে কৌশলগত দূরপাল্লার ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। এটি একটি সমন্বিত বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। আধুনিক সমন্বিত বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় থাকে লোকবল, সরঞ্জাম, অস্ত্র, রাডার, ব্যাটারি ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাঠামো। চীনের এ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম মূলত রাশিয়ার এস-৩০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থার উন্নত সংস্করণ। এইচকিউ-৯-পি এর অপারেশন রেঞ্জ ৩০০ কিলোমিটার। এটি তার এইচটি-২৩৩ রাডারের সাহায্যে মোট ১০০টি টার্গেটকে শনাক্ত করতে পারে। ১২টি টার্গেটের বিরুদ্ধে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করতে সক্ষম। এই রাডারটি ইসরায়েল ও চীনের যৌথ উদ্যাগে গৃহীত প্রকল্পে তৈরি করা হয়। প্রতিটি ক্ষেপণাস্ত্র ৩৫ কিলোমিটার উচ্চতায় যেকোনো টার্গেটকে ধ্বংস করতে সক্ষম।


এস ৪০০ 

বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে কার্যকরী ও সর্বাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা হচ্ছে এস-৪০০ | রাশিয়ার উৎপাদিত এ প্রযুক্তি মূলত দেশটির পূর্বের এস-৩০০ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার উন্নত সংস্করণ এস-৪০০ একই সময়ে ৩৬টি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে এমনকি একই সময়ে ৭২টি মিসাইল ছুড়তে সক্ষম। এতে রয়েছে অতিরিক্ত শনাক্তকারী রাডার, টাওয়ার ও এন্টেনা পোস্ট, যা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নেওয়া যায়। এর রাডারের ক্ষমতা প্রায় ৬০০ কিলোমিটার আর মিসাইলের ক্ষমতা ৪০০ কিলোমিটার পর্যন্ত। বর্তমানে রাশিয়া অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এস-৫০০-এর পরীক্ষা চালাচ্ছে।


বিভিন্ন দেশের উল্লেখযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র

দেশ ও ক্ষেপণাস্ত্রের নাম নিম্নরূপ:

পাকিস্তান

গজনভী, বাবর, শাহিন, নসর, ঘুরি, আবাবিল, আবদালি, হাতফ

ভারত 

অগ্নি, আকাশ, নাগ, সূর্য, পৃথ্বী, নির্ভয়, ব্রহ্মস, অগ্নি-পি বা অগ্নি-প্রাইম, ত্রিশূল, বারাক, অমোঘ, সাগরিকা, প্রহার

ইসরায়েল

বারাক, জেরিকো, পাইথন, স্পাইডার, লাহাত, স্পাইক

উত্তর কোরিয়া 

তায়েপোডং, হাওয়াসং, উনহা, পুকগুকসং, নোডোং, KN-23

ইরান 

শাহাব, ফজর, জেলজাল, কিয়াম, ফাতেহ, জোলফাগার, নাসর বা বিজয়, মেশকাত, মেহরাব, কাওসার, Qiam 1 

যুক্তরাষ্ট্র 

হারপুন, টমা হক, UGM-133A Trident II, LGM-30 Minuteman, RUM-139 VL-ASROC, AGM-158C LRASM, AGM-88 HARM 

রাশিয়া

RS-24 Yars, স্ট্রেলা, R-36, R-36M, তেসরিকুন, RS-28 Sarmat, Novator 9M729 

চীন 

Dongfeng, B-611, Julang, Hongjian, Chang Ying 

ফ্রান্স 

M51, Apache


Post a Comment

0 Comments

Close Menu