৬ আগস্ট আর ৯ আগস্ট মানব সভ্যতার ইতিহাসে দুটি কলঙ্কময় দিন। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, আগস্ট মাসের ৬ ও ৯ তারিখে বিশ্বে প্রথম পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয় জাপানের দুই শহর হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে। রচিত হয় হিরোশিমা আর নাগাসাকির ধ্বংসযজ্ঞের এক বর্বরতম অধ্যায়। এত নৃশংস, এত ঘৃণ্য আক্রমণ এর আগে কখনো পৃথিবী দেখেনি । এক মুহূর্তে হিরোশিমায় প্রায় দুই লাখ এবং নাগাসাকিতে প্রায় ৮০,০০০ মানুষের মৃত্যু হয় ।
জাপানের রাজধানী টোকিও'র দক্ষিণ-পশ্চিমে ৬৮০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত শহর হিরোশিমা। ১৫৮৯ সালে মোরি তেরুমতো নামের এক ব্যক্তি হিরোশিমার গোড়াপত্তন করেন, যা ১ এপ্রিল ১৮৮৯ শহরের মর্যাদা লাভ করে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষের ভালোবাসায় তিলে তিলে গড়ে তোলা সমৃদ্ধ এ শহর ৬ আগস্ট ১৯৪৫ লিটলবয় নামক পারমাণবিক বোমার আঘাতে মনুষ্যবিহীন, প্রাণহীন এক ভয়াবহ ধ্বংসস্তূপ, এক বেদনার্ত বিরানভূমিতে পরিণত হয়। মানব ইতিহাসে পারমাণবিক বোমার প্রথম শিকার হয় হিরোশিমা আর এ শহরের নিরপরাধ অসহায় মানুষ। ৬ আগস্ট ১৯৪৫ হিরোশিমার পুরো নাকাজিমা জেলাটি একটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। একসময়ের প্রাণবন্ত জেলাটিতে কোথাও এতটুকু প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর সেই জেলাটিকে আবার নতুন করে গড়ে তোলা হয়। নতুন করে প্রাণ ফিরে পায় পুরো অঞ্চলটি । ইতিহাসের সেই ভয়ঙ্কর কালো অধ্যায়কে পৃথিবীর মানুষকে প্রতিনিয়ত স্মরণ করে দেয়ার জন্য ১৯৫৪ সালে এখানে নির্মাণ করা হয় বিশ্ব শান্তির প্রতীক ‘হিরোশিমা পিস মেমোরিয়াল পার্ক'। জাপানিদের কাছে যা Hiroshima Heiwa Kinen Koen নামে পরিচিত। পার্কের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে পারমাণবিক বোমার ধ্বংসলীলার নীরব সাক্ষী মতোইয়াসু নদী। এ নদীর এক পাড়ে রয়েছে 'অ্যাটমিক বোম ডোম' আর অন্য পাড়ে রয়েছে পার্কের বাকি অংশ। প্রায় ১,২২,১০০ বর্গ মিটার জায়গা জুড়ে এ পার্কটি বিস্তৃত। পার্কটি ঘিরে রয়েছে পিস মেমোরিয়াল হল, পিস মেমোরিয়াল মিউজিয়াম, সিনোট্যাফ, অ্যাটমিক বোম ডোম এবং পিক ক্লক টাওয়ারসহ ইতিহাসের স্মৃতি বিজড়িত নানা স্থাপনা ।
নাগাসাকি
ষোড়শ শতকের শেষ দিকে সৃষ্টি হয় নাগাসাকি শহরের। ১৫৪৩ সালে এখানে প্রথম ইউরোপীয় হিসেবে পর্তুগীজদের পা পড়ে। ১৮৫৯ সালে নাগাসাকিকে উন্মুক্ত বন্দর হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বন্দরনগরী নাগাসাকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ নগর হিসেবে পরিণত হয়। কারণ, যুদ্ধের অধিকাংশ সরঞ্জাম তৈরি হতো এ নাগাসাকিতেই। হিরোশিমার ঘটনার আঘাত ঠিকমতো বুঝে ওঠার আগেই দু'দিন পর ৯ আগস্ট ১৯৪৫ দ্বিতীয় পারমাণবিক হামলার শিকার জাপানের নাগাসাকি শহর। পারমাণবিক বোমাটির নাম ছিল ফ্যাটম্যান। ‘পারমাণবিক বোমায় নাগাসাকি মারা যায়'— এ সহজ বাক্যটি বলে দেয় সে বোমার ভয়াবহতা কেমন ছিল। মৃত মানুষের শহর না হয়ে নাগাসাকি হয়ে ওঠে মৃত শহর হিসেবে। যারা বেঁচে ছিলেন তারা শহর ছেড়ে চলে যান অন্যত্র। তেজস্ক্রিয়তার কারণে বন্য পশু-পাখিরাও স্বাভাবিক জীবনে স্থির হতে পারেনি। কিন্তু এত বছর পরের দৃশ্য দেখলে যে কেউ অবাক না হয়ে পারবে না। নাগাসাকি বদলে গেছে। ক্ষতচিহ্ন পুরোপুরি না সারলেও শহরটি দেখে বোঝা যায়, অর্ধ শতক আগে কী ভয়াবহতার ভিতর দিয়ে গেছে শহরটি। জাপানের অবকাঠামো উন্নয়নের চমকপ্রদ উদাহরণ নাগাসাকি। প্রতিটি দালান রং করা। আকাশচুম্বী দালানের সারিও দেখা যায় এখন। শহরের ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীতে ছুটছে নানা জলযান। মানুষজন শান্তভাবে হেঁটে ফিরছে যে যার মতো। অফিস, রেস্টুরেন্ট, স্কুল-কলেজ সবই চলছে আপন গতিতে। নগরের গতির সাথে চোক জুড়ানো আলোকসজ্জা দেখা যায় রাতে।
0 Comments