Ad Code

Responsive Advertisement

বাংলার খ্যাতনামা সাহিত্যিক জীবনানন্দ দাশ

জীবনানন্দ দাশ স্বভাবসিদ্ধ ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে রবীন্দ্রপ্রভাব থেকে নিজেকে দূরে রেখেছিলেন। বাংলা কবিতা তাঁর পদশব্দে অনুরণিত হয়ে উঠেছে। তিনি তাঁর নিজের কাব্যাদর্শ সম্পর্কে বলেছেন, 'আমার কবিতাকে বা এ-কাব্যের কবিকে। নির্জন বা নির্জনতম আখ্যা দেওয়া হয়েছে; কেউ বলেছেন, এ কবিতা প্রধানত প্রকৃতির বা প্রধানত ইতিহাস ও সমাজচেতনার, অন্যমতে নিশ্চেতনার; কারও মীমাংসায় এ কাব্য একান্তই প্রতীকী; সম্পূর্ণ অবচেতনার, সুররিয়ালিস্ট।

জীবনানন্দ দাশ


প্রায় সবই আংশিক সত্য- সমগ্র কাজের ব্যাখ্যা হিসেবে নয়। প্রকৃতি মগ্নতা তাঁর বৈশিষ্ট্য। তাঁর প্রকৃতিপ্রেম আসলে এক ইন্দ্রিয়চেতনাই অবচেতনার অতল অবধি তার মূল প্রসারিত। তাঁর কাব্যে প্রকৃতিপ্রীতির অজস্র নিদর্শন বিদ্যমান। বাংলাদেশের প্রকৃতি তাঁর কবিতায় অত্যন্ত আকর্ষণীয় রূপে বিধৃত হয়েছে। রূপসি বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ জন্মগ্রহণ করেন ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯। তাঁর স্মরণে আজকের এ আয়োজন।


জন্ম : ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯, বরিশালে (আদি নিবাস বিক্রমপুরের গাওপাড়া গ্রামে)। 

কবির মা: জীবনানন্দ দাশের মা কুসুমকুমারী দাশও ছিলেন একজন কবি।

শুদ্ধতম কবি : বাংলা ভাষায় তাকে ‘শুদ্ধতম কবি’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। 

উপাধি লাভ : রূপসি বাংলার, নির্জনতার, তিমির হননের ও ধূসরতার কবি। 

মৃত্যু : ২২ অক্টোবর ১৯৫৪, কলকাতা (ট্রাম দুর্ঘটনায় মারা যান)। 

জীবনানন্দ দাশের উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম 

কাব্য : ঝরা পালক (প্রথম প্রকাশিত কাব্য), ধূসর পাণ্ডুলিপি, বনলতা সেন, মহাপৃথিবী, সাতটি তারার তিমির, রূপসী বাংলা (স্বদেশপ্রীতি ও নিসর্গময়তা এই কাব্যের মূল বিষয়), বেলা অবেলা কালবেলা। 

প্রবন্ধ: কবিতার কথা। 

উপন্যাস: মাল্যবান, সুতীর্থ, কল্যাণী, বাসমতির উপখ্যান, মৃণাল, কারুবাসনা।


জীবনানন্দ দাশের "রূপসী বাংলা" কাব্য যেন বাংলার প্রকৃতির প্রতিচ্ছবি


বাংলাদেশের প্রকৃতি জীবনানন্দ দাশের কাবিতায় অত্যন্ত আকর্ষণীয় রূপে বিধৃত হয়েছে। তিনি বাংলার প্রকৃতিকে সূক্ষ্মভাবে অবলোকন করেছেন বলেই রূপসি বাংলার কবি হিসেবে সুপরিচিতি লাভ করেন। ভাব ও কাঠামোগত দিক থেকে পশ্চিমাদর্শের অনুসারী হলেও তাঁর কবিতা বাংলার প্রকৃতি এবং মানুষের জীবন ও জীবন সংকটের ঘনিষ্ঠ পরিচায়ক। বাংলা সাহিত্যের নির্জনতার কবি জীবনানন্দ দাশের সর্বাধিক জনপ্রিয় কাব্য ‘রূপসী বাংলা'। এ কাব্যটির কারণে তিনি মৃত্যুর পরে ‘রূপসি বাংলার কবি’ স্বীকৃতি পেলেও, তার জীবদ্দশায় কাব্যটি প্রকাশিত হয়নি। তাঁর মৃত্যুর পর এর পূর্ণাঙ্গ পাণ্ডুলিপি আবিষ্কৃত হয়। কাব্যটি প্রকাশের সময় কবিভ্রাতা অশোকানন্দ দাশ স্বাক্ষরিত ভূমিকায় বলা হয়- ‘এই কাব্যগ্রন্থে যে কবিতাগুলো সংকলিত হলো, তার সবগুলোই কবির জীবিতকালে অপ্রকাশিত ছিল। তাঁর মৃত্যুর পরে কোনো কবিতা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। কবি এ কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদ নাম নির্বাচন করেছিলেন 'বাংলার এস্ত নীলিমা’। 


যদিও প্রকাশকালে 'রূপসী বাংলা স্থির করা হয়। অশোকানন্দ দাশের সরাসরি তত্ত্বাবধানে কাব্যটি প্রকাশিত হয় কবির মৃত্যুর তিন বছর পর ১৯৫৭ সালে। মূল খাতায় শিরোনামহীন ৭৩টি কবিতা থাকলেও তা থেকে বাছাই করে ৬১টি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থটি ‘সেই দিন এই মাঠ' কবিতা দিয়ে শুরু আর 'ভেবে ব্যথা পাব কবিতা দিয়ে শেষ হয়। উদ্ধারকৃত পাণ্ডুলিপির কবিতাগুলো শিরোনামহীন ছিল বিধায় পরবর্তীতে কবিতাগুলোর প্রথম লাইন দ্বারা প্রতিটি কবিতার শিরোনাম দেওয়া হয়। কাব্যের নামকরণ এবং উৎসর্গ বিষয়ে বিতর্ক থাকলেও সনেট আকারে লেখা ‘রূপসী বাংলা'র কবিতাগুলোতে কবি তাঁর প্রিয় অক্ষরবৃত্ত ছন্দই ব্যবহার করেছেন। জীবনানন্দ দাশ 'রূপসী বাংলা' কাব্যগ্রন্থে গাছ, ঘাস, নদী, পাখি ইত্যাদির রূপ-সৌন্দর্য নিখুঁতভাবে উপস্থাপন করেছেন। প্রতিটি পঙ্ক্তিতে আবহমান বাংলার রূপ-বৈভবের প্রতিভাস উৎকীর্ণ। 


অতিলৌকিক আবহ ঘুরেফিরেই তাকে আচ্ছন্ন করেছে। পাতা ঝরে পড়ার বিষণ্নতা থেকেও তিনি বিচ্ছিন্ন নন। তাই তার কবিতায় তিনি দৃঢ়ভাবে বাংলায় থাকার দৃঢ় প্রত্যয়। ব্যক্ত করেছেন 'তোমার যেখানে সাধ চ'লে যাও- আমি এই বাংলার পারে রয়ে যাব; দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে; দেখিব খয়েরি ডানা শালিখের সন্ধ্যায় হিম হয়ে আসে ধবল রোমের নিচে তাহার হলুদ ঠ্যাং ঘাসে অন্ধকারে’ কবি জীবনানন্দ দাশ যেন বাংলার প্রকৃতির সাথে মিতালি করেছেন। তাই বাংলার প্রকৃতির প্রতি বিমোহিত কবি যেন পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে আগ্রহী নন ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর : অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছে চেয়ে দেশি ছাতার মতন বড়ো পাতাটির নিচে বসে আছে ভোরের দোয়েল পাখি জীবনানন্দ দাশের কবিতার আবহের মধ্যে ঘুরেফিরেই ইতিহাস লুকোচুরি খেলেছে। 


ইতিহাসের ঐতিহাসিক চরিত্রকে তিনি তাঁর কবিতায় প্রতিনিয়ত পুনরুজ্জীবিত করতে সচেষ্ট ছিলেন। বাংলার রূপের মধ্যে তিনি খুঁজেছেন লোকজ পুরাণকে, ইতিহাসের প্রবহমানতাকেও তিনি এড়িয়ে যাননি। তাঁর ইতিহাস ও পুরাণ চেতনারপরিচয় পাওয়া যায় ‘অশ্বত্থের সন্ধ্যা হাওয়া' কবিতায় ‘মধুকূপী ঘাস-ছাওয়া ধলেশ্বরীটির পাড়ে গৌরী বাংলার এবার বল্লাল সেন আসিবে না জানি আমি-রায়গুণাকর আসিবে না-দেশবন্ধু আসিয়াছে খরধার পদ্মায় এবার, কালীগহে ক্লান্ত গাংশালিখের ভিড়ে যেন আসিয়াছে ঝড়, আসিয়াছে চণ্ডীদাস-রামপ্রসাদের শ্যামা সাথে সাথে তার; শঙ্খমালা, চন্দ্রমালা : মৃত শত কিশোরীর কঙ্কণের স্বর। কোনো কোনো কাব্য কবিকে অমরতা দেয়, তাঁর জাত চিনিয়ে দেয়। তেমনি একটি কাব্য 'রূপসী বাংলা'। 


কাব্যটিকে কবিতা আকারে শিরোনাম না দিয়ে একটি সম্পূর্ণ কবিতা হিসেবে বাংলার প্রকৃতির চিত্রকল্প অভিধা হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এ কবিতার কেন্দ্রীয় চরিত্র বাংলার প্রকৃতি, জীবনানন্দের অপূর্ব শব্দ চয়নে যা হয়ে উঠেছে গভীর অসুখে আক্রান্ত পৃথিবীর শুশ্রূষার মতো। এ কাব্যে কবির ভাবনার পুষ্প-বৃক্ষ-লতা-গুল্মগুলোর একটি সচিত্র রূপরেখা তৈরি করা হয়েছে। শুধু এই কাব্যগ্রন্থ থেকেই অনুমেয় কবি তাঁর ভাবনার ভান্ডারে কত বিচিত্র অনুষঙ্গ এনে জড়ো করেছিলেন। কত বিচিত্রতায় ভরিয়ে তুলেছিলেন তাঁর প্রিয় রূপসি বাংলাকে। আর এভাবেইরূপসী বাংলা হয়ে ওঠে জীবনানন্দ দাশের সমগ্র কবিকৃতিরই মুখচ্ছবি তথা বাংলার প্রতিচ্ছবি। আমরা যেখানে খুঁজে পাই আত্মপরিচয়ের শিকড় কাহিনি। জন্মভূমির প্রতি ভালোবাসার এক মহৎ সঙ্গীত এখানে উদ্ভাসিত। জীবনানন্দ দাশের 'রূপসী বাংলা' কাব্যগ্রন্থে প্রায় ৭০টি ফুল-ফল-বৃক্ষ ও লতা-গুল্মের ছবি এবং সংশ্লিষ্ট উদ্ধৃতি স্থান পেয়েছে। 


একটিমাত্র কাব্যগ্রন্থে বিশাল উদ্ভিদজগতের এমন বিস্তার রীতিমতো বিস্ময়কর। সুবিশাল বট-অশথ থেকে শুরু করে অতি ক্ষুদ্র একটি বুনোফুলও তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। বর্তমান এবং পরবর্তী প্রজন্ম যেন পলিমাটির এসব আত্মজকে খুব সহজেই চিনতে পারে, সে লক্ষ্য থেকেই এই কাব্য। আলোকচিত্রের পাশাপাশি প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতিগুলো এই গ্রন্থের একটি উল্লেখযোগ্য দিক। একই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অধিকাংশ পুষ্প-বৃক্ষের সমনাম এবং বৈজ্ঞানিক নামগুলো। এ গ্রন্থ একজন কৌতূহলী প্রকৃতিপ্রেমিক থেকে শুরু করে গবেষক- লেখকেরও মনের খোরাক জোগাবে। এ কাব্যের কবিতায় উপমা প্রয়োগে জীবনানন্দ অপরিসীম দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। যেমন : 'বাঘিনীর গর্জনের মতো অন্ধকার’, ‘শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা নেমে আসে’, ‘ধানের গন্ধের মতো লক্ষ্মী পেঁচা'- উপমার অনন্য ব্যবহারের পাশাপাশি স্পর্শ, দর্শন, ঘ্রাণ, শ্রবণ ইত্যাদি ইন্দ্রিয়ের প্রয়োগ লক্ষণীয়। 


এককথায় এসব শব্দ আমাদেরকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এবং ইন্দ্রিয়াতীত অনুভূতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাসমূহ সম্পর্কে ইরাবান বসু রায় ‘রূপসী বাংলার জীবনানন্দ' প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন- 'এই কবিতাগুলোর সারা শরীরে ছড়িয়ে আছে এক প্রগাঢ় ভালোবাসা, কিন্তু সে ভালোবাসা কোনো নির্বস্তুক বায়বীয় কল্পনাবিলাস নয়। যে বাংলাদেশকে ভালোবেসেছেন কবি, সে বাংলাদেশ শরীরি হয়ে ওঠে শুধু প্রকৃতিতে নয়, ইতিহাসের এ কথা ঠিক যে, সেই ইতিহাসের গায়ে আছে উপকথার আবরণ, কখনোবা অতিকথাও, কিন্তু সেই উপকথা, রূপকথা, আর অতিকথার মানুষজন নিয়েই জেগে ওঠে এক বাংলাদেশ, সে বাংলাদেশে নেই কোনো নাগরিক আকাশরেখা, তা শুধু ভরে থাকে আম কাঁঠালের গন্ধে, হিজলের ছায়ায়, সেখানে আজও যেন সপ্তডিঙা মধুকরের যাওয়া আসা । তাই বলা যায়, 'রূপসী বাংলা' যেন বাংলার প্রকৃতির প্রতিচিত্রের পাশাপাশি কবির প্রকৃতিপ্রীতির সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শন।

Post a Comment

0 Comments

Close Menu